চাপ উপেক্ষা করেই নির্বাচন
‘সেলফি কূটনীতি’ যে আওয়ামী লীগকে চাপমুক্ত করেছে, এমন আলামত রাজনীতির মাঠে নেই। তলে তলে সব সমাধান হয়ে গেছে, আর কোনো সমস্যা নেই বলে আওয়ামী লীগ যে দাবি করে আসছিল বিদেশিদের সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে অনড় অবস্থান দৃশ্যত সেই দাবির সঙ্গে মিলছে না। বিদেশি চাপ বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশাকে পাশ কাটিয়ে সংবিধান অনুযায়ী আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে অনড় অবস্থানেই আছে। ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর ঢাকাকেন্দ্রিক লাগাতার কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা করছে দলটি।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির দাবি অগ্রাহ্য করে নির্বাচন করতে গেলে সংঘাত পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, এমন পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ।
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সক্রিয়। দেশটির গত তিন মাসের তৎপরতা রীতিমতো চাপে ফেলে দিয়েছে সরকারকে। বাইডেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ঢাকায় আসা-যাওয়া, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক স্পষ্ট করে দিয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন দেশটির কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একপর্যায়ে মার্কিন সরকারের চাপের কড়া সমালোচনা করতে শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। পাশাপাশি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার সঙ্গে সরকারের চাওয়ার মিল রয়েছে দাবি করে দেশটির চাপ সহনীয় পর্যায়ে আনারও চেষ্টা করেছেন সরকারের মন্ত্রী ও দলের নেতারা।
দেশি-বিদেশি চাপে আওয়ামী লীগ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার অঙ্গীকারও করে আসছে। তবে এ অঙ্গীকার আমলে নিচ্ছে না মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। দেশের ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ফোরামেও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অঙ্গীকার করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের শেখ হাসিনার অঙ্গীকার আস্থায় নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে অবস্থান পরিবর্তনও করেনি মার্কিন প্রশাসন।
আবার আইন ও সংবিধানের বাইরে গিয়ে বিএনপির আন্দোলন ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার ব্যাপারেও ব্যাপক অনীহা সরকারের। যেকোনো মূল্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার পথে এগিয়ে চলছে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বিদেশিদের সঙ্গে তলে তলে সমাধান হয়ে গেছে দাবি করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। জি-২০ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেলফি ও সাবলীল আলোচনাকে সমাধানের উদাহরণ হিসেবেও তুলে ধরেন। একইভাবে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে বাইডেনের শুভেচ্ছাবিনিময়, স্বল্প সময়ের আলাপের বিষয়টিকেও পুঁজি করার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ। গত সপ্তাহে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের বৈঠক ব্যঙ্গ করে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমেরিকায় পিটার হাসের মুরব্বিদের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। তলে তলে যখন সব শেষ তখন আর এসব করে লাভ কী। পিটার হাসকে দেখিয়ে নির্বাচন বন্ধ করবেন, সেই খেলা খেলতে দেব না।’
ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ঢাকা সফরে ছিল। তারা ফিরে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ৫টি সুপারিশ করে, যেখানে নির্বাচন নিয়ে জটিলতা নিরসনে কার্যকর সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনড় অবস্থান সংলাপ অনুষ্ঠানকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। যদিও দু-দলই বলছে, সংলাপ হতে পারে। তবে দু-দলই শর্ত রেখেছে।
সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার ঢাকা সফরে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে গেছেন। গুঞ্জন রয়েছে একটি ফর্মুলা দিয়ে গেছেন তিনি। এ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যে বদলায়নি সেটা বোঝা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত বদলায়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আনুষ্ঠানিক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অবস্থানের হেরফের লক্ষ করা যায় না। তারাও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে। আওয়ামী লীগ সরকারও সেই অঙ্গীকার করেছে। বিএনপি অসাংবিধানিক দাবি তুলেছে। সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার যে বদ্ধ পরিকর সেটা তারা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এ নিয়ে বাদানুবাদ বা দ্বিমত সৃষ্টি হয়নি।
সেসব বৈঠকে উপস্থিত আরেক নেতা বলেন, এখানে আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি আছে। ফলে মিটিং-সিটিংয়ে দ্বিমত সৃষ্টি না হলেও মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে পরিষ্কার অবস্থান নিতে পারছে না। ফলে চাপের বিষয়টি হালকা হয়ে গেছে, এমনটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বোঝাপড়ার ঘাটতি না থাকলেও কোনো একটা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। শত চেষ্টা করে সে জায়গা থেকে তাদের সরানো যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু একটা জায়গায় স্থির হয়ে রয়েছে, আওয়ামী লীগও নির্বাচনের আগে দেশটিকে আর গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আগে জাতির কাছে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবে সরকার। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনে কাজ করবে। সেটা মাথায় রেখেই নির্বাচন প্রস্তুতির দিকে এগিয়ে চলছে আওয়ামী লীগ।
কূটনীতি নিয়ে কাজ করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এমন এক সদস্য বলেন, ‘আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে নিরপেক্ষ রাখতে। সেটা অনেক দূর এগিয়েছেও। নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য সব সহযোগী দেশের অবস্থান নিরপেক্ষ করে নির্বাচন সম্পন্ন করাই আমাদের লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন ও ভারতের সমর্থনও আমাদের দরকার।’
যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা কতটুকু সফল হবেন জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এ নেতা বলেন, দেশের মানুষ ভোট দেবে। যত বেশি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে সেটার ওপর সব পরিস্থিতি নির্ভর করবে।
এখন পর্যন্ত ভারতের অবস্থান স্পষ্ট নয়। তবে ভারত সঙ্গে থাকবে এমন প্রত্যাশা আওয়ামী লীগের। সেপ্টেম্বরে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী দিল্লি সফর করেছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল ভারত গিয়েছিল। এ ছাড়া ভারত যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের বিষয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আওয়ামী লীগের চেষ্টা একটি সফল নির্বাচন উপহার দেওয়া। তার ভেতর দিয়ে দেশি-বিদেশি সব চক্রান্ত নস্যাৎ করা হবে।’
আওয়ামী লীগের আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান বলেন, ‘দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশি-বিদেশি সব চাপ মোকাবিলা করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের লক্ষ্য।’ তিনি বলেন, ‘কে পক্ষে কে বিপক্ষে সে দুশ্চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ। কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করে অসাংবিধানিক ও অন্যায় দাবি মেনে নেওয়া হবে না। নির্বাচন আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহযোগিতা করবে, জনগণ ভোট দেবে এটাই শেষ কথা আমাদের।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যারাই যখন ঢাকায় এসেছেন নির্বাচন নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় কোনো দ্বিমত হয়নি। বিএনপির দাবি যে অসাংবিধানিক এবং সেটা মানা সম্ভব নয় এটাও জানানো হয়েছে তাদের। তারা বুঝতে পেরেছেন সরকার কী চায়।’