Bangladesh

চাহিদার চেয়ে পশু বেশি ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধের এক যুগ

  • কোরবানিতে দেশি পশুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ

দেশে কোরবানি দিতে একসময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মায়ানমারের ২২ থেকে ২৫ লাখ গরু আমদানি করতে হতো। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালে ভারত সরকার বাংলাদেশে গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ করলে বিপাকে পড়তে হয়। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের কোরবানিতে চাহিদার অতিরিক্ত ২০ লাখ ৬৮ হাজার পশু উদ্বৃত্ত থাকবে।

দেশে এবার কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা এক কোটি ২৪ লাখ ৩৭ হাজার পশুর মধ্যে ৭০ শতাংশ সরবরাহ করা হবে দেশের তিনটি বিভাগ থেকে। দেশি পশুতেই কোরবানির অর্থনীতি ছাড়াবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সেতু ডেইরি ফার্মের সত্বাধিকারী সাজ্জাদ হোসেন সেতু কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কয়েক মাস ধরে ১২টি গরু লালন-পালন করছেন। এর মধ্যে গত রোজার ঈদে ছয়টি গরু বেশ ভালো দামে বিক্রি করেন।

আর এখন কোরবানির ঈদে বাকি ছয়টি গরু বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গরু লালন-পালনের পাশাপাশি তিনি এআই কর্মী হিসেবে প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ২০০টি কৃত্রিম প্রজনন করান। তাঁর এই কার্যক্রমের মাধ্যমে এলাকায় গরু লালন-পালনে যথেষ্ট স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন স্থানীয় তরুণ ও নারীরা। ওই অঞ্চলে আনুমানিক আড়াই মণ ওজনের প্রতিটি গরু ৮০ থেকে ৯৫ হাজার টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে।

আরেকটু বড় আকারের আনুমানিক পাঁচ মণ ওজনের গরু বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ৭০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকায়। মাঝারি আকারের গরুর দাম এখনো বেশ ভালো পাওয়া যাচ্ছে। তবে আগামী কয়েক দিন পর হয়তো গরুর দাম আরেকটু সহনীয় হতে পারে।

দেশের পশু লালন-পালন ও কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমের প্রতীকী চিত্র সাজ্জাদ হোসেন সেতু। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘দেশে কোরবানি ও রোজার ঈদে যত পশু লাগুক না কেন, তা দেশের খামারিরাই উৎপাদন করার সক্ষমতা রাখেন।

এর জন্য পশুখাদ্যের দাম কমানো ও পশু পালনের উদ্যোক্তাদের ঋণ ও অর্থায়ন করতে হবে। এ ছাড়া পশুপালনে উন্নত জাতের অভাব দূর করতে ভালো মানের ব্রিড ও সিমেনের  (বীজ) সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই মূহূর্তে দেশে শাহিওয়াল গরুর বীজের বেশ চাহিদা রয়েছে। অবাধে মাংস ও পশু আমদানি বন্ধ করতে হবে। পশুর রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে তোলা ও প্রজনন ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলেই দেশ পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।

বাংলাদেশে গরু রপ্তানি ঠেকাতে ২০১৪ সালের এপ্রিলে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশের পর বৈধ পথে বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধের আগে ২০১৩ সালে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল ২৩ লাখ। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই এই চাহিদা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয় দেশীয় খামারিদের উদ্যোগে। তবে অবৈধভাবে দেশের তিন-চারটি করিডর দিয়ে গরু প্রবেশের চেষ্টা করা হয়। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে সেটিও কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

চলতি ২০২৫ সালে কোরবানির জন্য আট লাখ ৮৭ হাজার ৫৪৪টি খামারে এক কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি কোরবানির পশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতেই রয়েছে ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯টি, দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪টি এবং খুলনা বিভাগে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮৭টি। রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনা এই তিন বিভাগে মোট কোরবানির পশুর প্রায় ৭০ শতাংশ জোগান দেবে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ আসবে শুধু রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) প্রাথমিক হিসাবে দেশে এবার ৬৭ হাজার কোটি টাকার কোরবানির পশু বিক্রি হবে। এর মধ্যে অনলাইনে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি পশু বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।

কোরবানির সময় বিভিন্ন পশুর ৯০ থেকে এক কোটি চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে মোট চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সরবরাহ করা হয় কোরবানির ঈদে। সব মিলিয়ে এবারের কোরবানির অর্থনীতি ছাড়াতে পারে এক লাখ কোটি টাকা।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশীয় পশুতেই এবারের কোরবানি করা সম্ভব হবে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় খামারিরা। স্থানীয় পর্যায়ে পশু উৎপাদন বেড়েছে। যার কারণে পশু আমদানি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। অবৈধভাবে পশু অনুপ্রবেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। দেশের কোরবানির পশু নিরাপদ রাখতে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পশুর হাটে পশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সব মিলিয়ে এবারের কোরবানির অর্থনীতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে।’

গত অর্থ বছরে প্রায় ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে। এর মধ্যে (প্রজননক্ষম হওয়া) গাভি ও বকনাতে কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে ৩৮ লাখ ৮১ হাজার। অন্যদিকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাছুর উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১৬ লাখ ৯৬ হাজার। এ ছাড়া ব্রিডিং বুল থেকে সিমেন উৎপাদন করা হয়েছে ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার ডোজ।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের ধারণা করা চাহিদার চেয়ে প্রকৃত চাহিদা বেশি হতে পারে। ইফেকটিভ চাহিদা বাড়াতে পশুর দাম আরো সহনীয় করতে হবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক বছরের পুরান বীজ (সিমেন) দিয়ে পশু প্রজনন করানো হচ্ছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রম আরো বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। কৃত্রিম প্রজননে এখনো মাঠ পর্যায়ে বৈজ্ঞানিকভাবে সব প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ভালো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে এআই কর্মীদের আরো প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ডা. মো. বয়জার রহমান বলেন, ‘পশু লালন-পালনের স্বনির্ভরতার পেছনে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিশেষ করে গরু মোটাতাজাকরণ, কৃত্রিম প্রজনন ও মানসম্পন্ন ব্রিডের সম্প্রসারণ, খামারিদের সহায়তা প্রদানে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ ও বেসরকারি খাতের ভূমিকা রয়েছে। দেশের মানুষের যে হারে মাংসের চাহিদা বাড়ছে, তাতে কৃত্রিম প্রজননকে আরো বেগবান করতে হবে। কিন্তু আমরা চাই দেশীয় পশুর জাত সংরক্ষণ করতে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d