Bangladesh

চিকিৎসায় দেরি বাড়াচ্ছে মৃত্যু

এক বছর আগে স্তনে পিন্ড বা চাকা টের পান সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার বাসিন্দা মাসুদা বেগম। কিন্তু বিষয়টি কাউকে বলেননি তিনি। মাস কয়েকের মধ্যে ব্যথা শুরু হলে তিনি পরিবারের সদস্যদের জানান। ছুটে যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে। চিকিৎসক কিছু ওষুধ দিলে ব্যথা চলে যায়। চার মাস পর তীব্র ব্যথা নিয়ে তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে পরীক্ষা করে স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে মাসুদা যখন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন, তত দিন তার ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে।

খুলনার রূপসা উপজেলার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আবদুস সালামের ক্যানসার যখন ধরা পড়ে, তখন তা পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। তার ফুসফুস ক্যানসার শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

সালামের ছেলে ফয়সাল বলছিলেন, খুলনার বিভিন্ন হাসপাতাল ও চেম্বারে চিকিৎসক দেখিয়েছেন। একেকজন একেক রকম পরীক্ষা ও ওষুধ দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত খুলনা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর জানতে পারেন তার বাবা ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত। এখন জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।

কেবল মাসুদা বেগম কিংবা আবদুস সালামই নন, বেশির ভাগ ক্যানসার রোগীর ক্ষেত্রেই রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু হয় অনেক দেরিতে। এতে করে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

প্রথম যখন ক্যানসারের উপসর্গ দেখা দেয় তখন রোগী বুঝতে পারেন না। তারা ওষুধের দোকান কিংবা স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে যান। তারাও সঠিক পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হন। এভাবে সময় যায় আর ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী, প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার ধরা পড়লে অনেক ক্ষেত্রেই তা নিরাময় হয়।

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার বাবরু মিয়া মারা যান বছর তিনেক আগে। তার ছেলে মাসুক মিয়া বলেন, ‘আব্বার ক্যানসার হয়েছে এটা যখন আমরা জানতে পারি তার দুই মাস পর তিনি মারা যান। অথচ শেষ দুই বছর উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে তাকে কত ডাক্তার দেখালাম। কেউই বললেন না ক্যানসার। পরে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার ক্যানসার শনাক্ত হয়।’

ক্যানসার শনাক্ত করার ক্ষেত্রে যেমন দেরি বা ভুল হচ্ছে, তেমনি চিকিৎসার সুযোগও অনেক কম। পর্যাপ্ত হাসপাতাল ও সরঞ্জামের তীব্র সংকট রয়েছে। ১৭ কোটি মানুষের জন্য দেশে একটা মাত্র পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ঢাকার মহাখালীতে এই হাসপাতাল ছাড়াও সরকারি পর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসা হয়। তবে এগুলোতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নেই।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী বলেন, ‘যেসব রোগীর অপারেশনের প্রয়োজন হয়, তাদের ঢাকায় স্থানান্থর করতে হয়। আমাদের চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও থেরাপির প্রয়োজন হয়, যেখানে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে ৯টি ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে কয়েকটি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসা হয়। এর মধ্যে দুটি ছাড়া আর কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ নয়। গত বছর দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর ক্যানসার (আইএআরসি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন করে দেড় লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৮ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় শয্যা আছে মাত্র ৫০০; অর্থাৎ একটি শয্যার বিপরীতে রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার। আক্রান্তের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে। অন্যরা চিকিৎসাসেবার বাইরে থাকছে।

অবশ্য দেশে কতসংখ্যক মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত, সে-সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই স্বাস্থ্য বিভাগ কিংবা সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছে। এ বিষয়ে ক্যানসার সোসাইটি ও জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে তারা একই কথা বলেন।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের দেশে ক্যানসার রোগীর তুলনায় চিকিৎসা-সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। দীর্ঘদিন এদিকে নজর দেওয়া হয়নি, সরকার এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরও মনোযোগী হওয়া উচিত।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘ক্যানসার চিকিৎসার অপ্রতুলতার বিষয়ে আমরা অবগত। আমরা সাধ্য অনুযায়ী সমাধানের চেষ্টা করব।’ 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যানসার চিকিৎসায় দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ২০২২ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে।

জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের চিত্র : হাসপাতালের প্রবেশ পথেই চোখে পড়ে ‘সূচনায় পড়লে ধরা ক্যানসার রোগ যায় যে সারা’ স্লোগান লেখা পোস্টার। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই হাসপাতালে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও চিকিৎসা পায় না রোগীরা। রোগী অনুযায়ী, ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে ৫-৭ গুণ বেশি শয্যা প্রয়োজন। জেলা পর্যায় থেকে চিকিৎসার জন্য এসে ভোগান্তিতে পড়ে রোগীরা। ভর্তি হতেই অপেক্ষা করতে হয় এক থেকে দেড় মাস।

সিলেটের শিবগঞ্জ থেকে ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন মুহিবুর রহমান। ১৬ জানুয়ারি হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মুহিবুর বলেন, সিলেট ওসমানী হাসপাতালে তার ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি হতে। কিন্তু ১৫ দিন ধরে হাসপাতালে ঘুরেও তিনি ভর্তি হতে পারছেন না।

মানিকগঞ্জ থেকে এসেছেন তানবীর জামান। তিনি বলেন, ‘ফজরের নামাজ পড়ে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। তখনো আমার সামনে লম্বা লাইন ছিল। দুপুর ১২টায় আউটডোর থেকে টিকিট সংগ্রহ করে ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছেন। ভর্তি হতে গেলে বলা হয়, শয্যা খালি নেই। কবে খালি হবে, তা-ও জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।’

বহির্বিভাগে আসা রোগীদের অভিযোগ, নানা ভোগান্তির পর চিকিৎসক দেখাতে পারলেও দ্রুত চিকিৎসার নিশ্চয়তা নেই। প্রথমেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতেই ৭-১০ দিন লেগে যায়। রিপোর্ট নিয়ে যখন চিকিৎসক দেখান, তখন ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু শয্যা খালি পাওয়া যায় না।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কোনো কোনো রোগীর শয্যা পেতে এক মাসের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। প্রতিদিন ভর্তি হতে আসে ৫০০-৬০০ রোগী।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভর্তি হতে দেরি হওয়ার কারণে সেখানে গড়ে উঠেছে দালালচক্র। যাদের টাকা দিলে শয্যা পেতে আর ভোগান্তি হয় না। হাসপাতালের বর্তমান যে চিত্র তাতে দালাল ছাড়া ভর্তি হওয়া কষ্টসাধ্য। শয্যা পেতে দালালকে দিতে হয় ৫-৭ হাজার টাকা।

ভর্তি হতে আসা রোগীদের ঘিরে হাসপাতালের আশপাশে গড়ে উঠেছে আবাসন-বাণিজ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, তার মতো আরও ৮-১০ জন রোগীর আশপাশে বাসা ঠিক করে দেন। একেকটি কক্ষের জন্য প্রতিদিন ৩০০-৭০০ টাকা দিতে হয়। তারা ৫০ টাকা করে কমিশন পান।

যাদের সামর্থ্য নেই, তারা হাসপাতালের দোতলা ও প্রশাসনিক ভবনের সামনের খালি জায়গায় রাত কাটান। মাঝেমধ্যে তাদের তাড়িয়ে দেন নিরাপত্তায় থাকা আনসার ও হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মীরা। রোগীদের অভিযোগ, তারা যাতে বাধ্য হয়ে ভাড়া বাসা নেন, সে জন্যই আনসার সদস্যরা তাদের তাড়িয়ে দেন। কারণ তারা দালালদের কাছ থেকে কমিশন পান।

ক্যানসার হাসপাতাল ঘিরে গড়ে উঠেছে আরেকটি দালালচক্র। তারা রোগীদের হাসপাতালের বাইরে পরীক্ষা করানোর জন্য উৎসাহিত করে। হাসপাতালে মেশিন নষ্ট থাকার কথা বলে রোগীদের অন্য জায়গায় পরীক্ষা করাতে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে হাসপাতালের আউটসোর্সিংয়ের কর্মী, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের।

বিনামূল্যের ওষুধ মেলে না : নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি হওয়া রোগীদের বিনামূল্যে হাসপাতাল থেকে ওষুধ দেওয়ার কথা। কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময় ওষুধ দেওয়া হয় না। তবে দালালদের টাকা দিলে পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী জানান, প্রায় ছয় মাস আগে ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কেনা হচ্ছে না।

নানা অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আবু হেনা মোস্তাফা জামান বলেন, ‘হাসপাতাল কেন্দ্র করে যে দালালচক্র গড়ে উঠেছে তা নির্মূলে আমরা কাজ করছি। হাসপাতালের পরিচালক স্যার ও আমরা মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করছি। রোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছি।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d