Hot

চিকিৎসায় ভুল বা অবহেলায় নেই প্রতিকার, নেই আইন

বুকে ব্যথা নিয়ে এক সপ্তাহ আগে রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসক দেখান মোশাররফ হোসেন। ২১ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হন। অস্ত্রোপচারের আগমুহূর্তেও সুস্থ ছিলেন। তবে অস্ত্রোপচার শেষে তাঁর নিথর দেহ বের করে আনা হয়। ছেলে আতিকুর রহমান লিটুর অভিযোগ, ভুল চিকিৎসায় তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছে।

লিটু সমকালকে বলেন, ‘২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাবার মৃত্যু হলেও রাত সাড়ে ৯টায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খবর জানায়। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে কর্তৃপক্ষ টাকা ও চাকরির প্রলোভন দেয়। অধ্যাপক মঞ্জুরুল আলমের অধীনে অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। তাঁর সহকারীরা অস্ত্রোপচার করেন।’

যদিও পরিবার এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) লিখিত অভিযোগ করেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, অস্ত্রোপচার হয় তিন ঘণ্টা ধরে। এর মধ্যে অধ্যাপক মঞ্জুরুল আসেন এবং কাজ শেষ করে চলে যান।

শুধু মোশাররফ হোসেন নন, ১৬ ডিসেম্বর রাত ৭টা ৫৭ মিনিটে গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয় আজিজুর রহমানকে। রাত ৯টা ২ মিনিটে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলেন মৃতের ছেলে সাজিদ হাসান। কলাবাগান থানায় মামলা করে তাঁর পরিবার। এর ভিত্তিতে জরুরি বিভাগে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া ডা. সজীব নজরুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গ্রিন লাইফ-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথমে মামলাটি হয়েছিল ১৭ জনের বিরুদ্ধে। হাসপাতালের কর্মকর্তারাও ছিলেন আসামি। কিন্তু এজাহার পরিবর্তন করে আসামি করা হয় কেবল ডা. সজীব নজরুলকে। এর পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, কোনো তদন্ত ছাড়া সজীব নজরুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন না হওয়ায় এই গ্রেপ্তারের মাধ্যমে চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা আবার স্পষ্ট হলো।

মোশাররফ বা আজিজুরের মতো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এমন অপ্রীতিকর ঘটনা নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অবহেলা, ভুল চিকিৎসা ইত্যাদি অভিযোগে হাসপাতাল ভাঙচুর, চিকিৎসক ও কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। তবে নির্দিষ্ট আইন না থাকায় মিলছে না প্রতিকার। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কিছুটা প্রতিকারের বিধান থাকলেও তাতে ভুক্তভোগীকে অভিযোগ করতে দেখা যায় না। তবে চিকিৎসায় অবহেলার ঘটনায় কেউ দ্বারস্থ হন উচ্চ আদালতের, আবার অনেক ভুক্তভোগী মামলা করেন দণ্ডবিধি আইনে। সে মামলায় অনেক সময় চিকিৎসককে পাঠানো হয় জেলহাজতে। দণ্ডবিধিতে মামলা করলেও প্রতিকার পাওয়ার নজির খুব একটা দেখা যায় না।

প্রতিনিয়ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসিতে করা হলেও বিচার পেতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। এখনও বিএমডিসিতে নিষ্পত্তিহীন ৭৮ শতাংশ অভিযোগ পড়ে আছে। এমনকি এসব অভিযোগের বড় একটি অংশের প্রমাণ মিলছে না তদন্তে।

বিএমডিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল থেকে গত ১ নভেম্বর পর্যন্ত ১৪৭ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫১টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে; বাদীপক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে ২০টি। ৩১টি ক্ষেত্রে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া ১৬ চিকিৎসকের নিবন্ধন বিভিন্ন মেয়াদে স্থগিত এবং একজনের স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সতর্কতার নোটিশ পেয়েছেন ১৮ শতাংশ চিকিৎসক এবং ১০ শতাংশকে ভর্ৎসনা করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৩৯ শতাংশ চিকিৎসককে দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা জানান, অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনে কিছু ত্রুটি রয়েছে। প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠলেও প্রতিকার মিলছে কম। এ জন্য রোগী সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন জরুরি।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষায় ২০১৫ সাল থেকে আইন প্রণয়নের চেষ্টা চলছে। বিগত সরকারের সময় চারবার খসড়া প্রণয়ন হলেও তা পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষার অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব উম্মে হাবিবা গত ১৩ নভেম্বর অধ্যাদেশটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে বলে এক চিঠিতে জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের খসড়াগুলোর মতো এবারও সুস্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করেছে সরকার। কমিশনের সুপারিশ নিয়ে অধ্যাদেশ প্রণয়ন যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছেন তারা।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার বিষয়টি পুরোপুরি প্রমাণ করা কঠিন। এ ছাড়া চিকিৎসকদের নানা সংগঠন শক্তিশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আরেকজন সাক্ষ্য দিতে চান না। এখানে বিপত্তি বাধে। এমন হাজারো মামলা চিকিৎসকের সাক্ষ্য গ্রহণের অভাবে ঝুলে আছে।

জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম বলেন, রোগী ও চিকিৎসক সুরক্ষায় একটি আইন করা জরুরি। সেখানে চিকিৎসকের অবহেলায় রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রতিকার কোথায় পাবেন– তার উল্লেখ থাকে। অধিকাংশ ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ওঠে বেসরকারি হাসপাতালে। তবে এসব হাসপাতাল তদারকিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা চোখে পড়েনি। স্বাস্থ্য সুরক্ষার যে আইনটি পাস হতে যাচ্ছে, তার মধ্যে এটি আরও যুগোপযোগী করা উচিত।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, রোগী ও চিকিৎসকদের সুরক্ষায় আইনি কাঠামো তৈরি করা জরুরি। তবে আওয়ামী লীগ বা অন্তর্বর্তী সরকার এটির গুরুত্ব অনুভব করছে না। চিকিৎসকদের প্রতিনিধি বা দলীয় নেতা হিসেবে আমার পরামর্শ, টাকা দিয়ে জনগণ চিকিৎসাসেবা নেয়। চিকিৎসায় ভুল বা অবহেলার বিচার পাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। তবে এ বিষয়ে আইনি কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বিএমডিসি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযোগ করলে বিচার পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। চিকিৎসকের অদক্ষতা, ভুল বা অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়। তবে বর্তমান ব্যবস্থায় এর বিচার সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। অন্যদিকে, চিকিৎসকরাও পার পেয়ে যাচ্ছেন।

বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘বিএমডিসির সক্ষমতার অভাব রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী জনবল নেই। চাইলেও অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের বিএমডিসি কাঠামোগত দুর্বল।’ অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভুল চিকিৎসার অভিযোগ অনেক আসে। প্রতিটি অভিযোগের গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button