Bangladesh

চিকিৎসা ওষুধে লাগামহীন খরচ

ক্যানসার হৃদরোগ লিভার ও কিডনির চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগী

রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন ফয়েজ উদ্দিন (৫৫)। ব্রেন টিউমার নিয়ে রাজধানীর নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তার ছেলে শিহাব উদ্দিন (৩১)। ফয়েজ উদ্দিন বলেন, ছেলের ব্রেন টিউমারসহ আরও বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। অপারেশন, ওষুধ, পথ্য সব মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন। এর আগে ডাক্তার দেখানো, টেস্ট করাতে সঞ্চয়ের ২ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমার বেতনে সংসার চালানোই কঠিন। তাই ছেলেকে বাঁচাতে ৩ লাখ টাকা ঋণ করেছি। জানি না আমি এ ঋণের টাকা কীভাবে শোধ করব?

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের ৬১ লাখ মানুষ প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে নামছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধের পেছনে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। দেখা গেছে, ক্যানসার, হৃদরোগ, লিভার ও কিডনির চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগী। কাটছে না দেশের চিকিৎসায় আস্থার সংকট। দেশের সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, সংকট, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা প্রকট। বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছে আস্থার সংকট, প্রতারণার ফাঁদ। দেশের জেলা শহর থেকে হৃদরোগ, স্ট্রোকের জরুরি রোগী নিয়ে ছুটতে হয় ঢাকাতে। ঢাকার বাইরে গড়ে ওঠেনি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা। স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির নামে সরকারি বরাদ্দ ও দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও লুটপাট নয়ছয়ে পরিবর্তন আসেনি স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। বেসরকারি হাসপাতালে টেস্টের দাম নির্ধারণ না হওয়ায় গলাকাটা দাম রাখা হয় রোগীর কাছ থেকে। হাসপাতালের ক্যাটাগরি নির্ধারণ করে মূল্য তালিকা নির্দিষ্ট না করায় অপারেশনের খরচ, শয্যা ভাড়া যে যার ইচ্ছামতো আদায় করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন হাসপাতাল রয়েছে মোট ৭৫০টি। এর বাইরেও সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিবন্ধনকৃত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট শয্যাসংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বেসরকারিতেই রয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার শয্যা। আর বেসরকারি রোগ নিরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে প্রায় ১০ হাজার ও ব্লাডব্যাংক ১৮০টি। গবেষকরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিমা ছাড়া দেশের চিকিৎসা ব্যয় কমানো অসম্ভব। যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে রোগের প্রকোপ, বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়ও। চিকিৎসা ব্যয় বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে ১৪ হাজারের বেশি রোগী ও পরিবারের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে সরকারের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। গত জুলাইয়ে ‘বাংলাদেশে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয়ের ধাক্কা ও দারিদ্র্য : ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য’ উপস্থাপন করে বিআইডিএস। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এই স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। অর্থাৎ তখন দেশে যত দরিদ্র মানুষ ছিলেন, তার মধ্যে ২০ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে এই স্বাস্থ্যগত কারণে। এর মূল কারণ চিকিৎসা বাবদ মানুষের পকেট ব্যয় বেড়ে যাওয়া। বিআইডিএস স্বাস্থ্য অর্থনীতি গবেষক ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া রোগীদের মাসিক ব্যয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। সবচেয়ে বেশি মাসে গড়ে ১৯ হাজার টাকা ব্যয় হয় ক্যানসার রোগীর। আর হৃদরোগের পেছনে ব্যয় হয় ৮ হাজারের বেশি। মূলত ওষুধ কিনতেই পকেট খালি হয় রোগীর। মোট চিকিৎসা ব্যয়ের অর্ধেকের বেশিই যায় ওষুধের পেছনে। এর পরই রয়েছে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসকের ফি।’ স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন রোগীকে চিকিৎসা নিতে নিজ পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৬৮ দশমিক ৫০ ভাগ টাকা। রোগীকে সবচেয়ে বেশি ৬৪ ভাগ টাকা ব্যয় করতে হয় ওষুধ খাতে। নিজ পকেট থেকে ব্যয় বাড়ার কারণে ১৬ দশমিক ৪ ভাগ রোগী প্রয়োজন থাকলেও চিকিৎসা নিতে পারেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আস্থার সংকট আছে। এখানে চিকিৎসা খরচ বেশি, চিকিৎসা নিতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হয় রোগীদের। চিকিৎসা সবই ঢাকা-কেন্দ্রিক। সরকারি হাসপাতালে কার্যকর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে সেবার দাম ও মান নির্ধারণ করে সেটা টানিয়ে রাখতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্যাটাগরি অনুযায়ী দাম ঠিক করে দিতে হবে। রোগী তার সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা নিতে পারবে। ডায়াগনস্টিকেও দাম নির্ধারণ করে মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রেসক্রিপশন অডিট চালু করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে ডায়াগনস্টিক সেবা জোরদার করতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto