International

চীনের নিপুণ খেলা মিয়ানমারে, পিছিয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র

চীন বহু বছর ধরে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে এলেও এবার কৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। রণাঙ্গনে দেশটির অগ্রসরমান বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে বেইজিং। সুনিপুণ এই কৌশলে চীন বিদ্রোহীদের দিয়ে জান্তাকে এবং সেনা শাসকদের ভয় দেখিয়ে বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাচ্ছে। উভয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছে তারা। 

চীনের এই সুবিধাজনক অবস্থানের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে সরাসরি দৃঢ় অবস্থান নিলেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে স্বীকৃতি বা তাদের জোরালো সমর্থন দিচ্ছে না ওয়াংশিটন। তবে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে জান্তাকে নিদারুণ বেকায়দায় ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়নের জন্যই মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ জোরদার করা উচিত বাইডেন প্রশাসনের। 

তিন বছর আগে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর থেকেই শুরু হয় প্রতিরোধ আন্দোলন। ধীরে ধীরে তা প্রবল সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়। এতে দেশটির বেশ কয়েকটি সশস্ত্র জাতিগত মিলিশিয়া বাহিনী অংশ নেয়। জাতিসংঘ বলছে, অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে ২৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ সংঘাতে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৫০ হাজার মানুষ। 

বিদ্রোহীদের জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গত বছর ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করার পর থেকে অন্তত ১২টি শহর দখল করেছে। রাখাইন, চিন এবং উত্তর শান রাজ্যে ৪০০টিরও বেশি জান্তা ঘাঁটি এবং ফাঁড়ি দখল করেছে তারা। মিয়ানমার-চীন সীমান্তে এ জোট কার্যকরভাবে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ক্রসিং দখল করেছে, যার মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য হয়। 

মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো বেইজিং সামরিক জান্তাকে সমর্থন করছে কিনা। সাদামাটা চোখে এটা স্বাভাবিক যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের কর্তৃত্ববাদী প্রকৃতির কারণে জান্তাকেই সমর্থন করবে। তবে মিয়ানমারের চলমান সংকটের জটিল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চীনের ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রে শুধু সেই কথিত মতাদর্শগত একক উপাদান যথেষ্ট নয়। চীন অন্তত এক দশক ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে খেলছে। এরই অংশ হিসেবে এখন অনেক এলাকায় জান্তাবিরোধীদের সমর্থন করছে।

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এনজে হান চ্যানেল নিউজ  এশিয়াকে বলেছেন, সামরিক জান্তা এবং জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন উভয়কেই সমর্থনের প্রস্তাব দিয়ে চীন মিয়ানমারে তার বিরোধপূর্ণ সম্পর্ককে সতর্কতার সঙ্গে পরখ করেছে। 

অতীতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর অতি-নির্ভরশীলতা থেকে  শিক্ষা নিয়েছে বেইজিং।  ২০১০-১১ সালে বেইজিংয়ের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সামরিক জোট সরকার। তারা একতরফাভাবে ওয়াশিংটন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করে। এতে মিয়ানমারে দীর্ঘমেয়াদি চীনা স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। হুমকির মুখে পড়ে বেশ কয়েকটি চীনা বিনিয়োগ প্রকল্প।

এরপর থেকে বেইজিংয়ের চোখে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আর বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। ফলে বেইজিং ধীরে ধীরে অং সান সু চি এবং ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যোগাযোগ করে। ২০১৫ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর সু চি ক্ষমতায় এলে তাঁর সঙ্গে চীনের অত্যন্ত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

সম্প্রতি চীন সরকার ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। দৃশ্যত বেইজিং সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সাফল্যে সন্তুষ্ট এবং সীমান্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে তাদের ওপর ভরসা করছে। 

তবে চীনের কিছু সীমাবদ্ধতাও সম্প্রতি উন্মোচিত হয়েছে। বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং জান্তার মধ্যে বেশ কয়েকটি শান্তি চুক্তি হয়েছে, যার সর্বশেষটি গত মাসে ঘটেছে। তবে সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির পরদিনই উত্তর মিয়ানমারে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়। ১২ জানুয়ারি চুক্তির পরদিনই চীনের সীমান্তবর্তী উত্তর শান রাজ্যে ব্যাপক বন্দুকযুদ্ধ হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। 

ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের মিয়ানমার প্রোগ্রামের কান্ট্রি ডিরেক্টর জেসন টাওয়ার ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেছেন, চীন বর্তমানে চায় ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স দেশের উত্তরাঞ্চলের, অন্তত সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিক অবিলম্বে। 

জেসন বলেন, মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি নিজেদের সীমান্তে বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে চীন। তারা সীমান্তে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চায়। আরও চায় দক্ষিণ-পশ্চিম চীনকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া একটি ব্যয়বহুল অর্থনৈতিক করিডোরের পরিকল্পনা রক্ষা করতে সুবিধাজনক অবস্থান বজায় রাখতে।

ধীরে চলো নীতি যুক্তরাষ্ট্রের

ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ নিয়ে বহুমুখী চাপে থাকা যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে। জান্তার বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসে ২০২২ সালে বার্মা আইন বা বার্মা অ্যাক্ট পাস হয়। এতে মানবিক সহায়তা ছাড়াও সশস্ত্র গোষ্ঠী, বিরোধী ছায়া সরকার এবং গণতন্ত্রপন্থি সংগঠনগুলোর জন্য প্রযুক্তিগত এবং প্রাণঘাতী  নয়, এমন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা অনুমোদন করা হয়। তবে এ আইন কতটা কার্যকর হয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। 

ওয়াশিংটন বিভিন্ন সময় জান্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি এবং কোম্পানির ওপর দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সহিংসতা বন্ধ করার জন্য জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তবে মার্কিন ব্যাংকগুলোতে মিয়ানমার সরকারের থাকা ১০০ কোটি ডলার বিদ্রোহীদের দেওয়ার ব্যাপারে এখন সিদ্ধান্ত নেয়নি বাইডেন প্রশাসন।

এর কারণও রয়েছে। মিয়ানমারের রাজনীতিবিষয়ক গবেষক ইয়ে মায়ো হেইন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতির বিশেষজ্ঞ লুকাস মায়ার্স নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে লিখেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে গণতন্ত্রের পক্ষে অনেক কঠোর অবস্থানে নিয়েছে।  তবে বিদ্রোহীরা  জান্তাকে পরাজিত করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এখনও সংশয় রয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার সম্পর্কে হতাশাবাদের কথা শুনিয়ে আসছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, মিয়ানমারের বর্তমান মুহূর্তটি অতীতের বিদ্রোহের থেকে আলাদা কিছু নয়। আগের সব বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। তাছাড়া মিয়ানমারের অনেক জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন কাটিয়ে ওঠাও অসম্ভব হবে। এটা শেষ পর্যন্ত যে কোনো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে উঠতে পারে।

তবে ওই দুই বিশেষজ্ঞ বলছেন, বিদ্রোহীদের সাম্প্রতিক সাফল্য বলছে, এই ধারণা এবার ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে পারে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d