চীন রাশিয়া ভারতের রপ্তানি কত, কোন বাজারে যায় সেসব পণ্য

সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলন বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে এবারের সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যোগদান সম্মেলনটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যে এই সম্মেলন বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে রাশিয়া, চীন ও ভারতের একত্র হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্য কথায় বলা যায়, এ তিনটি দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলো এই সস্মেলনের মধ্য দিয়ে। দেখে নেওয়া যাক, এই তিন দেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ কত। তারা পরস্পরের সঙ্গে কী বাণিজ্য করে। খবর আল–জাজিরা।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির (ওইসি) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে চীন–ভারত–রাশিয়ার ত্রিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪৫২ বিলিয়ন বা ৪৫ হাজার ২০০ কোটি ডলার, ২০২২ সালে যা ছিল ৩৫১ বিলিয়ন বা ৩৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার। গত বছর এই বাণিজ্য আরও বেড়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলছেন। যে ব্যবস্থায় সুস্পষ্টভাবেই নেতৃত্বের আসনে থাকবে বেইজিং।
এসসিওর সদস্যদেশ ১০টি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প ক্ষমতার কাঠামো। এতে আছে মধ্য এশিয়ার বড় অংশ; সেই সঙ্গে রাশিয়া, চীন, ভারত, ইরান, পাকিস্তান ও বেলারুশ। বিশ্বের প্রায় ৪৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বসবাস এই ব্লকে; বৈশ্বিক জিডিপির ২৩ শতাংশ আসে এই ব্লক থেকে।
ওয়াশিংটনের বাণিজ্যনীতি নিয়ে অসন্তোষ বাড়তে থাকায় বেইজিংয়ের বহুপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ার এ উদ্যোগ আরও জোরালো হয়েছে। এসসিও সদস্যদেশগুলোর জন্য অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই প্ল্যাটফর্মের কেন্দ্র থাকবে চীন; দেশটি তার অর্থনৈতিক, সামরিক ও ভূরাজনৈতিক সক্ষমতার কারণেই এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে থাকবে।
চীনের রপ্তানি কোথায়
চীনের রপ্তানির বাজার বহুমুখী। ২০২৩ সালে চীনের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র; দেশটি সে বছর চীন থেকে প্রায় ৪৪২ বিলিয়ন বা ৪৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। চীনের মোট রপ্তানির প্রায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ এটি। এসব পণ্যের মধ্যে আছে ইলেকট্রনিক, যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য ও টেলিযোগাযোগ সরঞ্জাম।
আঞ্চলিকভাবে এশিয়াই চীনের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। গত বছর এশিয়ার দেশগুলোতে চীন রপ্তানি করেছে প্রায় ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে কেবল ভারতই কিনেছে ১২০ বিলিয়ন বা ১২ হাজার কোটি ডলারের পণ্য; এটি চীনের মোট রপ্তানির ৩ দশমিক ১ শতাংশ।
অন্যদিকে চীন ইউরোপে রপ্তানি করেছে ৮১৯ বিলিয়ন বা ৮১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে প্রধান গন্তব্য ছিল জার্মানি (১৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার), রাশিয়া (১১ হাজার কোটি ডলার) ও যুক্তরাজ্য (৯ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার)।
ভারতের রপ্তানি
ভারতের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে ৮১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ১৪০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে; এটি ভারতের মোট রপ্তানির ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এসব পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল ওষুধ; এরপর রয়েছে মূল্যবান পাথর, যন্ত্রপাতি ও টেক্সটাইল।
আঞ্চলিকভাবে এশিয়াই ভারতের রপ্তানির প্রধান বাজার। এ অঞ্চলে ভারত ১৭৮ বিলিয়ন বা ১৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। এ দেশটিতে গেছে ৩১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ১৪০ কোটি ডলারের পণ্য (মোট রপ্তানির ৬.৯ শত্ংশ)। এসব পণ্যের বড় অংশই ছিল গয়না ও পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম।
ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার নেদারল্যান্ডস। এ দেশটি কিনেছে ২২ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত ছিল পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম—প্রায় ১৫ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পেট্রোলিয়াম কিনেছে তারা। চীন ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার এবং এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম।
গত ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্য আমদানিতে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। তাঁর অভিযোগ, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভারত অব্যাহতভাবে রাশিয়া থেকে ছাড়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনছে। এভাবে নয়াদিল্লি মস্কোর যুদ্ধে অর্থায়ন করেই চলেছে।
এর জবাবে ভারত অসন্তোষ প্রকাশ করে এই শুল্ককে ‘অন্যায়, অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করে। একই সঙ্গে তারা স্বাধীনভাবে জ্বালানি নীতি নির্ধারণের সার্বভৌম অধিকারের কথা বলে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থাকা সত্ত্বেও মস্কোর দেওয়া উল্লেখযোগ্য ছাড়ের কারণে ভারত রাশিয়ার তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে তারা ঝুঁকেছে চীনের দিকে। তার অংশ হিসেবে এসসিও সম্মেলনেও অংশ নেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
রাশিয়ার রপ্তানি
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার রপ্তানি বাজার ছিল অনেক বৈচিত্র্যময়। অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটি (ওইসি)–এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে চীন ছিল রাশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। রাশিয়ার মোট রপ্তানির ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ (৭ হাজার ২১০ কোটি ডলার)। দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার ছিল নেদারল্যান্ডস (৮ শতাংশ বা ৩৯.৫ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৯৫০ কোটি ডলার)। এরপর ছিল যুক্তরাষ্ট্র (৫.৫ শতাংশ বা ২৭.৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭৩০ কোটি ডলার)।
কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে রাশিয়ার ব্যবসা–বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০২৩ সালে রাশিয়ার রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ (১২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার) গেছে চীনে। এরপর গেছে ভারতে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ (৬ হাজার ৬১০ কোটি ডলার)। তুরস্কে গেছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ (৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার)। অর্থাৎ এখন রাশিয়ার তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি রপ্তানি যাচ্ছে এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে। এর বড় অংশই হলো জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যশস্য, সার ও শিল্পের কাঁচামাল।
চীন-রাশিয়া বাণিজ্য
২০২৩ সালে রাশিয়ায় ১১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে চীন। এর বড় অংশই ছিল যন্ত্রপাতি ও পরিবহন খাতের সামগ্রী। এর মধ্যে গাড়ি ছিল শীর্ষ রপ্তানি পণ্য।
একই বছরে চীনে ১২৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে রাশিয়া। এর মধ্যে প্রধান পণ্য ছিল খনিজ সম্পদ, বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। জ্বালানি খাতে ভর করেই চীনের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত বহাল আছে। জ্বালানি খাতই মস্কোর রপ্তানির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ।
ভারত-রাশিয়া বাণিজ্য
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বিশাল বাণিজ্যঘাটতি আছে। ২০২৩ সালে রাশিয়া ভারতে ৬৬ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৬১০ কোটি ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে। এর প্রায় ৮৮ শতাংশ ছিল জ্বালানি—প্রধানত অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। জ্বালানির বড় অংশ ভারত ছাড়ে কিনেছে।
অন্যদিকে রাশিয়ায় ভারতের রপ্তানি ছিল মাত্র ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাত ছিল রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি ও ধাতু।
চীন–ভারত বাণিজ্য
চীনের সঙ্গেও ভারতের বড় বাণিজ্যঘাটতি আছে। ২০২৩ সালে চীন ভারতের কাছে ১২৫ বিলিয়ন বা ১২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে। এর মধ্যে যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক পণ্যই প্রধান। অপর দিকে চীন দেশে ভারত মাত্র ১৮ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮১০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে—তেল ও জ্বালানিসংশ্লিষ্ট পণ্যই ছিল প্রধান।
২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ছিল প্রায় ৯০ বিলিয়ন বা ৯ হাজার কোটি ডলার। সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের সব সদস্যদেশ মিলিয়ে ভারতের মোট রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি। সি ও পুতিন মোদির সঙ্গে হাসতে পারেন ঠিকই, কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কের ফলে যে রাজস্ব ক্ষতি হবে, সেটি তাঁদের পক্ষে কঠিন।