Jannah Theme License is not validated, Go to the theme options page to validate the license, You need a single license for each domain name.
Trending

চোখের সামনেই লুট: শেখ হাসিনার পতন থেকে লন্ডন পর্যন্ত অর্থ পাচারের তথ্যচিত্র

লন্ডনভিত্তিক দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি) নতুন একটি তথ্যচিত্র প্রচার করেছে আজ বৃহস্পতিবার। তথ্যচিত্রের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশের হারানো বিলিয়ন: চোখের সামনেই চুরি’। মূলত দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার এবং তা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নিয়ে তথ্যচিত্রটি তৈরি করা হয়েছে।

তথ্যচিত্রটি নিয়ে এফটি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার (২ লাখ ৩৪ হাজার ডলার বা ২৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা) বাংলাদেশ থেকে লুট হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই টাকা কীভাবে দেশ থেকে বের করে নেওয়া হয়েছিল এবং তা ফেরত আনা আদৌ সম্ভব কি না, এ নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বিক্ষোভকারী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে।

তথ্যচিত্রটির শুরুতেই দেখানো হয়েছে শেখ হাসিনার পতনের প্রেক্ষাপট। এ নিয়ে কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক রাফিয়া রেহনুমা হৃদি ও রেজওয়ান আহমেদ রিফাদ। পুরো তথ্যচিত্রে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেছেন, এফটির দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড, অ্যাগ্রিকালচার ও কমোডিটি করেসপনডেন্ট (আগে বাংলাদেশভিত্তিক সাংবাদিক ছিলেন) সুজ্যানা স্যাভিজ, স্পটলাইট অন করাপশনের ডেপুটি ডিরেক্টর হেলেন টেলর এবং ওয়েস্ট মিনস্টার লবি দলের রিপোর্টার রাফে উদ্দিন।

বাংলাদেশের হারানো বিলিয়নের খোঁজে

শুরুতেই বলা হয়, ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে শেখ হাসিনার শাসন নিয়ে জমে থাকা ক্ষোভ ফেটে পড়ে, যখন সরকার এমন একটি চাকরির কোটার প্রস্তাব আনে। আর এই প্রস্তাব আওয়ামী লীগের সদস্যদের আত্মীয়স্বজনকে সুবিধা দিত। হাসিনা ক্রমেই আরও স্বৈরাচারী হয়ে উঠছিলেন, বিরোধীদের গণহারে কারাবন্দী করছিলেন।

তবে কেবল কোটাব্যবস্থার কারণেই নয়, মানুষ আরও বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছিল হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতির মাত্রা দেখে—বিশেষ করে দেশের বিপুল অর্থ বিদেশে পাচারের গুঞ্জন নিয়ে। আর বাংলাদেশ থেকে চুরি হওয়া অনেক অর্থই যুক্তরাজ্যে গিয়ে পৌঁছেছে।

লন্ডন সংযোগ

তথ্যচিত্রে এ পর্যায়ে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল স্টেশন দেখিয়ে বলা হয়, স্টেশনটি থেকে বেরোলেই সাইনবোর্ডে লেখা দেখা যায় ‘ওয়েলকাম টু হোয়াইট চ্যাপেল’, কথাটি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও লেখা। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কত পুরোনো। মূলত ঔপনিবেশিক আমলে যখন বাংলাদেশ ছিল ভারতের অংশ, তখন থেকেই এই যোগাযোগ। দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত বা সংযোগ এত দৃঢ় যে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশিদের জন্য স্বাভাবিক বিনিয়োগের জায়গা হয়ে ওঠে। অবশ্য যুক্তরাজ্য বিশ্বজুড়েই বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয়। তবে যাদের আগে থেকেই সংযোগ আছে, তাদের জন্য তা আরও বেশি।

যুক্তরাজ্য অবশ্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয় তার বিশাল আর্থিক খাতের জন্য এবং একই সঙ্গে অত্যন্ত আকর্ষণীয় সম্পত্তির বাজারের কারণে। যুক্তরাজ্য এখন নির্বাসনে থাকা না থাকা, নানা প্রান্তের বাংলাদেশি রাজনীতিকদের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।

এফটির সাংবাদিকেরা বলেন, ‘আমরা যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক দল ও বড় দাতাদের যোগসূত্র খতিয়ে দেখছিলাম—এ সময়ই বাংলাদেশ শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তাই আমরা বুঝি—এটি এফটির জন্য বৈশ্বিক খবর। কারণ, হাসিনা ও তাঁর পরিবার নিজেরাও খুব বৈশ্বিক। তাঁর বোন শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যের নাগরিক আর শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টির এমপি—কিছুদিন আগে পর্যন্ত স্টারমার সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন।’

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের অ্যাগ্রিকালচার ও কমোডিটি করেসপনডেন্ট (আগে বাংলাদেশভিত্তিক সাংবাদিক ছিলেন) সুজ্যানা স্যাভিজ

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের অ্যাগ্রিকালচার ও কমোডিটি করেসপনডেন্ট (আগে বাংলাদেশভিত্তিক সাংবাদিক ছিলেন) সুজ্যানা স্যাভিজছবি: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যচিত্র থেকে নেওয়া

টিউলিপ সিদ্দিকসহ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির যে তদন্ত করছে, তাতে অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত। দুই পরিবারের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় জমি বেআইনি প্রভাব খাটিয়ে দখলের অভিযোগে মামলাও চলছে।

এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, এতে তাঁর মন্ত্রিত্বের উপযুক্ততা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়, যখন অভিযোগ ওঠে—তাঁর পরিবার নাকি দরিদ্র একটি দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছে।

এ পর্যায়ে সুজ্যানা স্যাভিজ বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে বহু বছর থেকেছি আর বাংলাদেশ কাভার করেছি—সে সময়ে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি অর্থ পাচারের বহু টিপস পেয়েছি। এরপর শেখ হাসিনার পতন হলে আমি সহকর্মী রাফে উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করি—কীভাবে এগুলো তদন্ত করা যায়।’

রাফে উদ্দিন তখন বলেন, ‘এক সূত্র আমাকে সম্পত্তির ও তা নিবন্ধনের কিছু নথি পাঠায়। এর একটি নথি বিশেষভাবে নজর কাড়ে। আর তা হলো লন্ডনের ট্রেন্ডি কিংস ক্রসে একটি ফ্ল্যাট, যা টিউলিপ সিদ্দিক ২০০০-এর দশকের শুরুতে পেয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ২২ বছরের বেশি হওয়ার কথা নয়। সম্পত্তিটি নাকি সিদ্দিককে হস্তান্তর করেছিলেন এমন একজন ডেভেলপার, যাঁর সঙ্গে সাবেক বাংলাদেশি শাসনের যোগসূত্র পাওয়া গেছে।’

এখান থেকেই টিউলিপ সিদ্দিককে কেন্দ্র করে তদন্তটি জোরালো হয়, যা আংশিকভাবে তাঁর চলতি বছরের শুরুর দিকে পদত্যাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তথ্যচিত্রে এ বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বক্তব্য প্রচার করা হয়। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘এটি পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, আমাকে হয়রানি করার চেষ্টা। আমি কিছু ভুল করেছি—এমন কোনো প্রমাণ নেই।’

তারপর তথ্যচিত্রে অন্যান্য দুর্নীতির তথ্য উল্লেখ করা হয়। যেমন টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে এফটির তদন্ত ছিল অনেক বড় এক জিগস পাজলের মাত্র একটি টুকরা—যেখানে সাবেক বাংলাদেশি শাসন-ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যুক্ত শত শত সম্পত্তি খতিয়ে দেখা হয়।

সুজ্যানা স্যাভিজ এ নিয়ে বলেন, ‘একজন বিশেষ ব্যক্তি, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে আমরা পাই, তিনি যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি সম্পত্তির মালিক।’

হেলেন টেলরের এ নিয়ে মন্তব্য হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশের একজন মন্ত্রীর জন্য যুক্তরাজ্যে অন্তত ৩০০টি সম্পত্তি কেনা—এটা বিস্ময়কর। যেখানে এক ব্যক্তি বছরে দেশের বাইরে ১২ হাজার ডলারের বেশি নিতে পারেন না।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ৩৫০টি সম্পত্তি শনাক্ত করে জব্দ করেছে, যা এফটির খোঁজ পাওয়া ৩০০টির বেশি সম্পত্তির সঙ্গে মিলে যায়। তবে সাইফুজ্জামান চৌধুরী এফটির পাঠানো কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেননি।

এ সময়ে জানানো হয়, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে অন্তর্বর্তী সরকার প্রাক্কলন করছে।

শেখ হাসিনার সময়কালে বাংলাদেশ

সুজ্যানা স্যাভিজ জানান, বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা মূলত দুই প্রধান দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে শেখ হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হন, আর এতেই বাংলাদেশের গতিপথ আমূল বদলে যায়।

এ পর্যায়ে তথ্যচিত্রে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (এসওএএস) অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক খানের বক্তব্য প্রচার করা হয়। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, হাসিনার শাসনে লুটপাট ছিল ব্যাপক। আর মোশতাক খান বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশে দুর্নীতির সাধারণ ধারা হলো—শাসক দলকে তার সমর্থকদের মধ্যে টাকা বিলাতে হয়। তা না হলে ক্ষমতায় টিকতে পারে না। যদিও এটা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। কেননা রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রকে কবজা করলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আমার মনে হয়, শাসনামলের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ অর্থনীতি ও নিজেদের দল—দুয়েরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল।’

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিডছবি: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যচিত্র থেকে নেওয়া

দুর্নীতি: ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার

এ অধ্যায়ের শুরুতেই জন রিড বলেন, শেখ হাসিনার শাসনকালে যা ঘটেছে, তার কিছু তো সিনেমার কাহিনির মতো।

এ বিষয়ে সে সময়কার শাসকদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ডিজিএফআইর সাহায্যে বিভিন্ন ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রসঙ্গটি আনা হয়। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি মুহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে আমাকে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানো হয়। ২০১৭ সালের প্রথম বোর্ড মিটিংটি স্বাভাবিক নিয়মে ব্যাংকের বোর্ডরুমেই হওয়ার কথা ছিল—কিন্তু বলা হলো, সেটা নিরাপদ নয়। আমার গাড়ি ডিজিএফআই সদর দপ্তরের দিকে ঘোরানো হয়। আমাকে ডিজিএফআই প্রধান জেনারেল আকবরের সঙ্গে দেখা করতে হয়। তিনি আমাকে বললেন, “সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ” চান আমি পদত্যাগ করি।’ এ পর্যায়ে জন রিডের প্রশ্ন ছিল, ‘সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলতে কাকে বোঝালেন?’ মুহাম্মদ আবদুল মান্নানের উত্তর ছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।

জন রিড এ পর্যায়ে মন্তব্য করেন, ‘আমরা এমন গল্পও শুনেছি—কিছু ব্যাংক পরিচালককে গোয়েন্দারা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যেত, শেয়ার হস্তান্তরের কাগজে সই করিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করত—আর সেই শেয়ার যেত পুরোনো শাসকদের ঘনিষ্ঠদের হাতে।’

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসফাইল ছবি

তথ্যচিত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য প্রচার করা হয়। যেমন তিনি এ সময়ে বলেন, ‘অবিশ্বাস্য হলেও তারা যা করেছে—বোর্ডকে অস্ত্রের জোরে সরিয়ে নিজেদের বোর্ড বসিয়েছে, তারপর নিজেদের আপনজনদের “ঋণ” দিয়েছে, যা আসলে ঋণই নয়; সবাই জানত, তা ফেরত দিতে হবে না।’

এরপর তথ্যচিত্রে বলা হয়, ব্যাংক দখলের প্রভাব পরিমাপের একটি ভালো উপায় হলো খেলাপি ঋণের হার দেখা, বিশেষ করে দখলের পর। যেমন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার আগেই খুব বেশি ছিল, ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে দখলের পর তা আরও বেড়ে যায়।

এ সময় সম্পদ উদ্ধার টাস্কফোর্সের একজন পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে ইফতি ইসলাম বলেন, তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো পরিবারের ব্যাংকে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকার কথা নয়; বাস্তবে এই গোষ্ঠীগুলোর কেউ কেউ একাধিক ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে নিজেদেরই ঋণ মঞ্জুর করায়। এসব জাল ঋণ দেওয়া হতো প্রায়ই কাল্পনিক কোম্পানিকে বা এমন ব্যক্তিকে, যার কোনো জামানত বা ঋণ শোধের সামর্থ্যই ছিল না।

এরপরই আসে এস আলম গ্রুপের নাম। সুজ্যানা স্যাভিজ এ নিয়ে বলেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমকে বাংলাদেশে ধনকুবের বলা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের অনুমান হচ্ছে, এস আলম ও তাঁর গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, এমনকি তার চেয়েও বেশি অর্থ বের করে নিয়েছে।

এফটি এস আলম গ্রুপের বক্তব্য নিয়েছে। তারা এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য বলেছে। এস আলম গ্রুপ আরও দাবি করেছে, বাংলাদেশে তাদের ব্যাংকগুলোর ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত।

এরপর তথ্যচিত্রে টাকা পাচারের নানা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেমন টাকা বিদেশে যায় মোটামুটি দুইভাবে। যেমন ‘ওভার ইনভয়েসিং’—অর্থাৎ আমদানির দামের চেয়ে অনেক বেশি দাম কাগজে দেখিয়ে টাকা পাঠানো; আর ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’—বিদেশে রপ্তানির আয় আসার কথা থাকলেও কম দেখিয়ে টাকা ফেরত না আনা। আরেকটি বড় মাধ্যম হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল। অর্থাৎ হুন্ডি, যাকে অন্য জায়গায় হাওলা বলা হয়। এটি বৈধ কাজেও লাগে আবার অবৈধ অর্থ পাচার সাফ করতেও (মানি লন্ডারিং) ব্যবহৃত হতে পারে। অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতোই বাংলাদেশে পুঁজি অন্য দেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বাইরে নেওয়া যায় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ব্যাংক ঋণ মঞ্জুর করলে সবাই নিজের অংশ নিয়ে নেয়, ঋণটি কখনোই ফেরত দেওয়া হয় না। আর এই ঋণের অর্থ পাচার করতে হুন্ডি নেটওয়ার্ক কাজে লাগে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ সময় জানান, এক হিসাব বলছে—ব্যাংকিং খাত ও ব্যবসায়িক খাত মিলিয়ে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুটপাট হয়েছে বিভিন্ন উপায়ে—সম্ভবত কোনো দেশের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় অর্থ লুণ্ঠন।

দুর্নীতির কথা সবাই জানত

জন রিড এরপর জানান, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন খতিয়ে দেখছে, সাবেক শাসন–ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে টাকা সরিয়েছেন কি না। এর একটি হলো পদ্মা সেতু, যে প্রকল্পে দুর্নীতির শঙ্কায় বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আরেকটি ছিল দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

ড. মোশতাক খান বলেন, এগুলোর কিছুই গোপন ছিল না, পত্রপত্রিকায় ছিল, মিডিয়ায় আলোচনা হতো, দুর্নীতি ছিল প্রকাশ্য, চোখের সামনে; কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা কারও ছিল না। অধিকাংশ মানুষ ছিল আতঙ্কে, তারা জানত কথা বললে গায়েব হয়ে যেতে পারে। ব্যাপক গুম, গুপ্ত কারাগারে আটকে রাখা, রহস্যজনক হত্যা—এসব চলত। দুর্নীতির কথা সবাই জানত, তবু চুপ করে থাকত।

শেখ হাসিনা ভারতে পালাতে বাধ্য হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়। আর তিনি ছিলেন শেখ হাসিনার কাছে খুব অপছন্দের। দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দিককার সিদ্ধান্তগুলোর একটি ছিল সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও সম্পদ উদ্ধার টাস্কফোর্সের প্রধান করা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরফাইল ছবি

এ সময় আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখি—অন্তত ১১টি ব্যাংকের পর্যাপ্ত তারল্য নেই, আমানতকারীরা টাকা চাইলে দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে হস্তক্ষেপ করে ব্যাংকগুলো টেকওভার করতে হয়, আগের মালিকদের হাতে থাকা শেয়ার বাজেয়াপ্ত করতে হয়। আর্থিক ব্যবস্থা সচল রাখতে ২৯০ বিলিয়ন টাকা ঢোকাতে হয়েছে। এখন কিছু ব্যাংকের “সিলেক্টেড রেজল্যুশন” করতে হবে, নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজতে হবে, এগুলো একীভূত বা একত্রীকরণ করে সুস্থ–স্বাভাবিকভাবে চলতে হবে।’

জন রিড এ সময় বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অনুমান করেন যে এস আলম গ্রুপ ডিজিএফআইয়ের (বাংলাদেশের একটি নিরাপত্তা সংস্থা) সহায়তায় ১০ বিলিয়ন ডলার বাইরে সরিয়ে নিয়েছে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের  স্পটলাইট অন করাপশনের ডেপুটি ডিরেক্টর হেলেন টেলর

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের স্পটলাইট অন করাপশনের ডেপুটি ডিরেক্টর হেলেন টেলরছবি: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যচিত্র থেকে নেওয়া

সংস্কার

তথ্যচিত্রে এরপর বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শুরুতে ড. ইউনূসের জনপ্রিয়তা ছিল বেশ। তিনি বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে খুব বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। তবে এখন পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়েছে। ড. ইউনূসের ওপর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার চাপ বাড়ছে। কিন্তু তিনি বলছেন, আগে বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

এ পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি বক্তব্য প্রচার করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের যতটা সম্ভব সংস্কার করতে হবে; আমরা আবার আরেকটি ফ্যাসিবাদী শাসন চাই না—যেখানে সরকারি কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ—সবকিছুকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।’

এরপর জন রিড বলেন, বিএনপি ছিল শেখ হাসিনার সময় সবচেয়ে বড় বিরোধী দল, তাদের জেতা প্রায় নিশ্চিত। আর সুজ্যানা স্যাভিজ বলেন, কিন্তু ওপরের স্তরে সরকার পাল্টালেও নিচে বিরাট আমলাতন্ত্র রয়েছে—যাদের খুব একটা বদল হয়নি।

অর্থ পাচার ও পুনরুদ্ধার

আত্মসাৎ করা অর্থ উদ্ধার করা প্রসঙ্গে ইফতি ইসলাম বলেন, ‘আপনি যখন শত শত মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলার চুরি করেন, তখন আপনি বিশ্বের সেরা আর্থিক কাঠামোবিদ, আর্থিক পরামর্শক ও আইনজীবীদের ভাড়া করতে পারেন, যাঁরা আপনার টাকা সরানো ও লুকাতে সাহায্য করেন। সম্পদ উদ্ধার টাস্কফোর্সের জন্য বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো, যারা এই সম্পদ লুট করেছে, তারা বহু আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছে। আপনি টাকার হদিস না পেলে তা ফেরত আনতে পারবেন না।’

জন রিড বলেন, বাংলাদেশ লড়াই করছে দক্ষ জনবল-সংকটে, যারা প্রাথমিক আইনি ও তথ্য ভিত্তি তৈরি করবে, যাতে টাকা ফেরত আনার মামলা এগোনো যায়।

সুজ্যানা স্যাভিজ যুক্ত করেন, সম্পদ উদ্ধারের আরেক সমস্যা হলো—এতে প্রায়ই সমঝোতা লাগে; অর্থাৎ যেই ব্যবসায়ী বা ধনকুবের টাকা চুরি করে দেশ থেকে বের করে নিয়েছে, তার সঙ্গে চুক্তি করা। তখন ভারসাম্য রাখতে হয়—একদিকে টাকা ফেরত আনা, অন্যদিকে বাংলাদেশিদের কাছে কী গ্রহণযোগ্য সেটা ঠিক করা।

ইফতি ইসলাম বলেন, ফৌজদারি মামলায় প্রমাণের মানদণ্ড অনেক উঁচু—তাই এই ভারসাম্য ঠিক রাখা বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এ বিষয়ে বলেন, ‘মানুষ বলে, সব টাকা আদায় সম্ভব নয়। আমরা যেটুকু পারি, সেটুকুই—কিন্তু তার জন্য কঠিন প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে, পথ অনুসরণ করতে হবে, সংশ্লিষ্ট বিদেশি সরকারের সহযোগিতা পেতে হবে।’

সুজ্যানা স্যাভিজ এ প্রসঙ্গে বলেন, যদি ইউনূস প্রশাসন অন্য দেশের সরকারগুলোকে—যেমন যুক্তরাজ্যে এনসিএ যা করেছে—তেমন পদক্ষেপে রাজি করাতে পারে, তাহলে চাকা ঘুরতে শুরু করবে এবং থামানো কঠিন হবে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, যারা শেখ হাসিনার আমলে অর্থ বাইরে নিয়ে গেছে, তারা ভবিষ্যতের সরকারের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করবে, তার ওপরেই নির্ভর করবে দেশে দুর্নীতি কতটা ব্যাপক থাকবে।

সংস্কার নিয়ে শেষ কথা

শেষ পর্যায়ে জন রিড বলেন, বাংলাদেশের ‘বিপ্লব’ একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে হলেও, এমনও হতে পারে যে দেশ আবার এমন এক অবস্থায় ফিরে যাবে, যেখানে একদল রাজনৈতিক শক্তির হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকবে, তফাত শুধু, এবার তা আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি হতে পারে।

এ বিষয়ে ড. মোশতাক খান বলেন, যাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ছিল খুব উঁচু। সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগবে। তবে এখন যে মৌলিক সংস্কারগুলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে, সেগুলোকে পেছনে ঠেলে দেওয়া যে কারও জন্য কঠিন হবে।

তথ্যচিত্রটি শেষ করা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রাফিয়া রেহনুমা হৃদির একটি বক্তব্য দিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভয়, আমরা হয়তো আমাদের শহীদদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারব না—এটাই এখন সবচেয়ে বড় আশঙ্কা।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d slot gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d
bacan4d
toto 4d
slot toto
slot gacor
toto slot
toto 4d
bacan4d login
bacan4d login
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d toto
slot toto
bacan4d
bacan4d
togel online
Toto Slot
saraslot88
Bacan4d Login
bacantoto
Bacan4d Login
bacan4d
bacan4drtp
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot maxwin
slot bacan4d
slot maxwin
bacan4d togel
bacan4d login
bacan4d login
bacan4d login
bacantoto 4d
slot gacor
bacansport
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot77 gacor
JAVHD
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
gacor slot
slot gacor777
slot gacor bacan4d
bacan4d
bacansport
toto gacor
bacan4d
bacansports login
slot maxwin
slot dana
slot gacor
slot dana
slot gacor
bacansports
bacansport
bacansport
bacansport
bawan4d
bacansports
bacansport
slot gacor
judi bola
slot maxwin
slot maxwin
bacansport
bacan4d
bacansport
slot gacor
slot demo
slot gacor
slot gacor
slot gacor
toto slot
slot gacor
demo slot gacor
slot maxwin
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacansport
slot gacor
bacansport
slot gacor
slot gacor
bacan4d
slot gacor
paito hk
bacan4d
slot gacor
bacansports
slot gacor
fenomena1688
pasaran togel
bacan4d
slot demo
bacan4d
slot toto
slot toto
slot toto