ছাগলকাণ্ড: ছুটি ছাড়াই নতুন কর্মস্থলে অনুপস্থিত মতিউর, বিদেশি পাসপোর্টে দেশ ছাড়ার গুঞ্জন
ছেলের ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমানকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। কিছু দিন ধরে বন্ধ তাঁর মোবাইল নম্বরও। আরেকজনের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে যোগদানপত্র দিলেও, এখন পর্যন্ত নতুন কর্মস্থলে উপস্থিত হননি মতিউর। এমনকি ছুটিও নেননি তিনি।
এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে মতিউরের দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। এমন ঘটে থাকলে তাঁকে পাওয়া কষ্টসাধ্য হবে। এরই মধ্যে মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী ও তাঁর ছেলে ছাগলকাণ্ডের হোতা মুশফিকুর রহমান ইফাত বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন।
ছাগলকাণ্ডের পর মতিউরের অবৈধ অঢেল বিত্ত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গত ২৩ জুন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সভাপতির পদ থেকে প্রত্যাহার করে তাঁকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করে সরকার। পরদিন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পর ২৫ জুন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ চিঠি দিয়ে মতিউরকে ওই দিনের একটি মিটিংয়ে সশরীরে থাকার নির্দেশ দেয়। কিন্তু মিটিং দূরে থাক, নতুন কর্মস্থলে এখন পর্যন্ত একদিনও অফিস করেননি মতিউর।
কানাডা থেকে একটি সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, সম্প্রতি দেশটির একটি শহরে মতিউরকে দেখা গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলছেন, মতিউর দেশেই আছেন। এ বিষয়ে মতিউরের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের একাধিক মোবাইল নম্বরে কল করেও সাড়া মেলেনি।
আরেকটি সূত্রের দাবি, মতিউরের নামে-বেনামে থাকা সম্পদের বিষয়ে দুদক ছাড়াও একাধিক সংস্থা অনুসন্ধান করছে। গত মাসের মাঝামাঝি তড়িঘড়ি করে ব্যাংক থেকে ৮ কোটি টাকা তুলে নেন তিনি। বর্তমানে জমা আছে ৪ কোটি টাকা। টাকা লেনদেনে বিভিন্ন সময় ১১৫টি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেছেন মতিউর।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), সিআইডির মানি লন্ডারিং ইউনিটসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মতিউরের অর্থ লেনদেনের তথ্য বের করতে অনুসন্ধান শুরু করেছে। তাঁর বিদেশি পাসপোর্ট রয়েছে কিনা, তাও তদন্ত করছে। দুর্নীতির অর্থে অনেকে পর্তুগালসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট নিয়ে থাকেন। মতিউরের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে কিনা, যাচাই করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাকরিবিধি অনুযায়ী বদলির দিনই সশরীরে নতুন কর্মস্থল অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে যোগদান করার কথা মতিউরের। কিন্তু তিনি বদলির একদিন পর ২৪ জুন ‘অসুস্থতার’ কথা উল্লেখ করে আরেকজনের মাধ্যমে যোগদানপত্র পাঠান।
সূত্র জানায়, একাধিক এনবিআর ও কাস্টমস কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য সামনে আসায় প্রতিষ্ঠানটির নীতিনির্ধারকরা ‘বিব্রত’। কর্মকর্তাদের অপকর্মের দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না বলে সাফ জানানো হয়েছে। তবে গতকাল রোববার পর্যন্ত মতিউরের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবশ্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, মতিউরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া সমকালকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে যোগদান করতে হবে সশরীরে। অন্য কারও মাধ্যমে যোগদানপত্র পাঠালে কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করতে পারে না। মতিউর রহমান সশরীরে যোগদান করেননি। পাশাপাশি ছুটি না নিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন, যা অসদাচরণ গণ্য হবে। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হতে পারে। বিভাগীয় মামলায় তিরস্কার থেকে বরখাস্ত পর্যন্ত করা যায়।
জানা যায়, নিজের নামে অঢেল সম্পদের পাশাপাশি মতিউর স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়দের নামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, নরসিংদী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে আছে এফডিআর এবং পুঁজিবাজারে শতকোটি টাকার বিনিয়োগ।
আলোচিত ছেলে ইফাতকেও কিনে দিয়েছেন বিলাসবহুল গাড়ি। বসুন্ধরায় আছে বাড়ি। গুলশানের সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় স্ত্রী থাকেন লালমাটিয়ার ৮ নম্বর রোডের ৪১/২ ইম্পেরিয়াল ভবনে। কাকরাইলেও ফ্ল্যাট রয়েছে। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামে ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাক্সেসরিজ কারখানা আছে মতিউরের। যদিও কাগজে-কলমে কারখানার মালিক তাঁর ভাই এম এ কাইয়ুম হাওলাদার।
ময়মনসিংহের ভালুকায় ৩০০ বিঘা জমিতে এবং বরিশালে গ্লোবাল শুজ নামে দুটি জুতা তৈরির কারখানা আছে। নরসিংদীর রায়পুরায় ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট রয়েছে। এসব রিসোর্টের মালিকানায় আছে তাঁর ছেলে ও মেয়ে। মতিউর পূর্বাচলে আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পটেরও মালিক।