ছাত্র হত্যার হোতা শতাধিক পুলিশ
রাজধানী ঢাকা থেকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে এই দুই সাবেক আইজিপিকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাবেক এই দুই আইজিপির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র হত্যার অভিযোগে হত্যা মামলা করা হয়। অভিযোগ আছে গণহত্যারও।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। এসব গুলির ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার।
আন্দোলনে গুলি চালিয়ে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন শতাধিক পুলিশ সদস্য।
সাবেক দুই আইজিপিকে গ্রেপ্তারের বিষয় নিশ্চিত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, সাবেক আইজিপি শহীদুল হক ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ডিবি হেফাজতে রয়েছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সাবেক আইজিপি শহীদুল হককে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয় কচুক্ষেত এলাকা থেকে।
আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞে সরাসরি অংশ নেওয়া ও নেতৃত্বদানকারী ৯৫ জন পুলিশ সদস্যের নামে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ২৮৪টি মামলা করা হয়েছে। গত ১৩ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত এসব মামলা করা হয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ৯১টি। সম্প্রতি কয়েকজন মাস্টারমাইন্ড পুলিশ সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮টি মামলা হয়েছে ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদের নামে। এর পরের অবস্থানে রয়েছেন পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তাঁর নামে মামলা হয়েছে ৩৬টি। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নামে মামলা হয়েছে ৩৩টি, ডিএমপি যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নামে ২৭টি, স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান মনিরুল ইসলামের নামে ১১টি, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসাইনের নামে আটটি মামলা হয়েছে।
এই ছয়জন হাই প্রফাইল পুলিশ সদস্যের মতো আরো শতাধিক পুলিশ সদস্য সরকারের কাছ থেকে আন্দোলন দমাতে যে মাত্রার নির্দেশনা পেয়েছেন প্রয়োগ করেছেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এ পর্যন্ত এ ধরনের ৯৫ জন পুলিশ সদস্যের নামে মামলা হলেও আরো বেশ কিছু পুলিশ সদস্যের নামে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা ও মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করার দায়ে মামলা প্রক্রিয়াধীন। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট বিকেলেও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গাজীপুর জেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় বেপরোয়া পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনা সরকার দফায় দফায় ইন্টারেট বন্ধ করে, যাতে ওই সময়ে পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া তাণ্ডব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না পায়। কিন্তু সম্প্রতি পর্যায়ক্রমে সেসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু করেছে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কিছু মামলার এজাহার এবং ওই সময়ের ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশের তাণ্ডবের বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকার নিজেদের হত্যা, গুম ও দুর্নীতি আড়াল করতে পুলিশ বাহিনীকে যততত্র ব্যবহার করেছে। এই সুযোগে কিছু পুলিশ সদস্য নিজের স্বার্থসিদ্ধি, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন, পদ-পদবির লোভে প্রায় সব ধরনের অপরাধ কর্মে জড়িয়েছে। ফলে সরকার পতনের পর ওই সব পুলিশ সদস্য অসংখ্য মামলার আসামি হচ্ছেন। অনেকে পলাতক, আবার কেউ কেউ হারিয়েছেন চাকরি।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা
সরকার পতনের পর ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালকে ব্রিফ করছেন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসাইন। তাঁর মোবাইলে একটি ভিডিও দেখিয়ে বলছিলেন, ‘গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’ এ সময় সেখানে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনও উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে গত ১৯ জুলাই বিকেলে রাজধানীর নিউ মার্কেটের পাশে নীলক্ষেত মোড়ে আব্দুল ওয়াদুদ (৪৫) নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার দায়ে তাঁর স্বজন আব্দুর রহমান বাদী হয়ে ২১ আগস্ট নিউ মার্কেট থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। ওই মামলায় সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুন ও ডিএমপির লালবাগ বিভাগের ডিবি ডিসি মশিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে মশিউরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার বাণিজ্য, হয়রানি, মানহানি ও পোস্টিং বাণিজ্যসহ আরো একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন বিকেলেও গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এসব গুলিতে অনেকে নিহত হয়েছেন। নিহতের অনেকের মরদেহের হদিস পর্যন্ত মেলেনি এখনো। এর মধ্যে গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানা এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন মো. হৃদয় (২০) নামের এক কিশোর। ঘটনার দিনের একটি ভিডিও সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ছেলেটিকে গুলি করার পর বস্তায় ভরে থানা নিয়ে যায় পুলিশ। ওই দিন তাঁর মতো আরো কয়েকজনের মরদেহ গুম করেছে থানা পুলিশ।
একইভাবে ৫ আগস্ট দুপুরের পর ঢাকার আশুলিয়া থানার প্রধান ফটকসংলগ্ন স্থানে একটি ভ্যানে রাখা ছিল বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ। ওই ভ্যানেই হাত-পা ধরে পুলিশকে আরেকটি লাশ তুলতে দেখা গেছে। সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে ওই দিনের ঘটনার এই দৃশ্য দেখা গেছে। পরে ভিডিওটি তদন্তে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ওই ঘটনায় সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সুপারনিউমারারি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আবদুল্লাহিল কাফীকে গত সোমবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। গতকাল কাফীর বিরুদ্ধে লাশ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা এবং হাজারীবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
কার নামে কত মামলা
ছয়জন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার বাইরে সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের নামে সাতটি, বেনজীর আহমদের নামে একটি, সাবেক সিআইডিপ্রধান মো. আলী মিয়ার নামে দুটি, সাবেক র্যাবপ্রধান হারুন অর রশিদের নামে দুটি, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অতিরিক্ত আইজি খন্দকার লুত্ফুল কবির ও জামিল আহমেদের নামে একটি করে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক র্যাবপ্রধান এম খুরশিদের নামে একটি, ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তারের (অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) নামে ছয়টি, ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিউদ্দিনের নামে দুটি, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের নামে একটি, ডিএমপির সিটিটিসির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো, আসাদুজ্জামানের নামে তিনটি, সিটিটিসির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার কামরুজ্জামানের নামে দুটি, সাবেক ডিআইজি রিপন সরদারের নামে একটি, এডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়াদ্দারের নামে একটি, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসানের নামে আটটি, আনিসুর রহমানের নামে একটি ও সঞ্জিত কুমার রায়ের নামে একটি, রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি রশিদুল হকের নামে একটি, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন সরদারের নামে একটি, রমনা বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ ইমামের নামে একটি, ডিএমপির ডিসি তানভির সালেহীন ইমনের নামে একটি, লালবাগ বিভাগের ডিবি ডিসি মশিউর রহমানের নামে দুটি, ডিসি ডিবি রাজিব আল মাসুদ ও মাহফুজুল আল রাসেলের নামে একটি করে মামলা হয়। ডিএমপির ডিসি জাহিদ তালুকদার ও মতিঝিলের ডিসি হায়াতুল ইসলামের নামে একটি করে, উত্তরার ডিসি আশরাফুল আজিমের নামে দুটি, তেজগাঁওয়ের ডিসি হাফিজ আল ফারুকের নামে একটি, মোহাম্মদপুরের সাবেক ডিসি এইচ এম আজিমুল হকের নামে একটি, লালবাগের ডিসি মাহাবুব-উজ-জামানের নামে একটি ও সাবেক ডিসি জাফরের নামে দুটি, ওয়ারী জোনের এডিসি নুরুল আমিনের নামে একটি, সবুজবাগ জোনের এডিসি গোবিন্দ চন্দ্রের নামে একটি, ডিবির এডিসি শাহিন শাহ মাহফুজের নামে একটি, ডিএমপির এডিসি হাফিজ আল আসাদের নামে একটি, কোতোয়ালি জোনের সাবেক এডিসি মুহিত কবির সেরনিয়াবাতের নামে একটি, লালবাগ জোনের সাবেক এডিসি শহিদুল আসলামের নামে একটি, ডিবির এডিসি জুয়েল রানা, হাসান আরাফাত, নাজমুল ইসলাম, আফজাল হোসেন টুটুল ও ফজলে এলাহীর নামে একটি করে মামলা হয়।
এ ছাড়া মতিঝিল বিভাগের এডিসি সাব্বির রহমান, মোহাম্মদপুর জোনের সাবেক এডিসি রওশানুল হক সৈকতের নামে একটি, ওয়ারী বিভাগের এডিসি শাকিল মোহাম্মদ শামীমসহ ৯৫ জন পুলিশ সদস্যের নামে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ২৮৪টি মামলা হয়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ খুবই নৃশংসতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। যেভাবে গুলি করে মানুষ মারা হয়েছে, এ ধরনের কাজ পুলিশের কাছ থেকে কখনো আশা করা যায় না। এসব নেতিবাচক ভূমিকার কারণে পুরো বাহিনী ইমেজ সংকটে পড়েছে। এই বাহিনীটিকে ফের দাঁড় করানো অনেক সময়ের ব্যাপার। এসব হত্যাকাণ্ডে বিপত্গামী যেসব পুলিশ সদস্য জড়িত তাঁদের শনাক্ত করে ফৌজদারি আইনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ কোনো সরকারের জন্য না, পুলিশ রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য, এটা উপলব্ধি করতে হবে। উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়াগুলো যদি অনুসরণ করা যায় তাহলে জনগণের মাঝে পুলিশ নিয়ে স্বস্তি ফিরবে। এসব কারণে পুলিশে মৌলিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি।