Bangladesh

ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়ার কুফল: মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে, কমছে ক্রয়ক্ষমতা

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়ার রেকর্ড গড়েছে সরকার। এসব অর্থ বাজারে এসে একদিকে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে কমিয়ে দিচ্ছে টাকার মান। 

উৎপাদনের চেয়ে টাকার প্রবাহ বেশি থাকায় বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের দাম। এতে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। ফলে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। রাজস্ব আয় না বাড়িয়ে ছাপানো টাকায় সরকার চলতি ব্যয় নির্বাহ করছে, যা দেশের পুরো অর্থনীতিকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। 

ছাপানো টাকার কুফলে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় বৈশ্বিকভাবেও দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর প্রতি আস্থার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। সব মিলে দুর্নাম হচ্ছে দেশের।

বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে বিদায়ি অর্থবছরে সরকারের আয় কমেছে, কিন্তু এর বিপরীতে ব্যয় বেড়েছে। বাড়তি ব্যয় মেটাতে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ মানেই হচ্ছে ছাপানো টাকা। বিদায়ি অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ৩১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। 

আলোচ্য সময়ে তিনগুণের বেশি ঋণ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি ঋণ গ্রহণের কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে গেছে। যে হারে টাকার প্রবাহ বাড়ছে, ওই হারে উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছে। 

ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়ার অন্যতম কুফল হচ্ছে চড়া মূল্যস্ফীতি। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। টাকার ক্ষয় হওয়ার কারণে মানুষের আয়ও কমে যাচ্ছে। এতে মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে চাহিদা কমাতে বাধ্য হচ্ছে। যারা দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন, তারা দারিদ্র্যসীমার মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। এতে দারিদ্র্য বাড়ছে। 

এ অবস্থা বেশি দিন চললে মানুষের শ্রেণিগত কাঠামোতে পরিবর্তন চলে আসবে। মধ্যবিত্তের আয় কমে তারা চলে যাবে নিম্ন মধ্যবিত্তে। নিম্নবিত্ত আরও নিচের স্তরে যাবে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর প্রতি দেশি ও বৈশ্বিকভাবে আস্থার ঘাটতি দেখা দেবে। যার নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী গাজীপুরে অবস্থিত দ্য সিকিউরিটিজ প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড বছরজুড়েই টাকা ছাপানোর কাজটি করে। ছাপানো টাকা প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে (টাকা জমা রাখার সুরক্ষিত স্থান) জমা রাখা হয়। 

ভল্টে থাকা অবস্থায় একে বলে ‘জড়বস্তু বা নন লাইভ’ টাকা। চাহিদা বাড়লে ছাপানো টাকা থেকে বাজারে ছাড়া হয়। ছাপানো টাকা বাজারে এলেই একে বলা হয় ‘লাইভ বা জীবন্ত’। অর্থাৎ, ছাপানো টাকা ভল্টে থাকলে মূল্যহীন কাগজ এবং বাজারে এলে মূল্যমান মুদ্রা। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন উপায়ে বাজারে টাকার জোগান দেয়। এর মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে অর্থের জোগান দিয়ে বিশেষ তহবিল গঠন করে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ প্রয়োজনে তারল্যের জোগান দিয়ে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেসব টাকা বাজারে ছাড়া হয়, এর সবই ছাপানো নোট আকারে নয়। বেশির ভাগই থাকে ইলেকট্রনিক আকারে। অর্থাৎ মুদ্রা সরবরাহের আদলে। মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো হলে তখন নগদ টাকার জোগানও বাড়াতে হয়। তখনই কেবল ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হয়। 

গত জুন পর্যন্ত মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাপানো নোট আকারে বাজারে রয়েছে। অর্থাৎ মোট মুদ্রা সরবরাহের সাড়ে ১৬ শতাংশের বেশি। বাকি অর্থ ইলেকট্রনিক আকারে রয়েছে। অর্থাৎ গ্রাহক চাইলেই ওই অর্থ নগদায়ন করতে পারবে। 

নগদায়নের চাহিদা বাড়লেই ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরবরাহ করা হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। যার ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকাই সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ হিসাবে নিয়েছে। বাকি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন তহবিল গঠন করে উৎপাদন খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ দিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ অর্থকে বলা হয় হাইপাওয়ার্ড মানি বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাকা। এগুলো বাজারে এসে টাকার প্রবাহ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, বাড়িয়ে দেয় জনভোগান্তির মাত্রা। 

টাকা ছাপানোর সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতি নেই। সরকারের আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং উৎপাদন কর্মকাণ্ড উৎসাহিত করতে চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান বাড়ায়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বিভিন্ন সম্পদের বিপরীতে ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়ে।

ছাপানো টাকার বড় অংশই আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে। সরকারের হিসাবে ঘাটতি হলেই এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার জোগান দেয়। আবার সরকারের হিসাবে টাকা জমা হলে তা সমন্বয় করে নেয়। 

কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দায় সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় এবং ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের হিসাবে টাকার জোগান কমছে। এর বিপরীতে খরচ বাড়ছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করায় মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে। তবে তা লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। গত অর্থবছরে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। 

এর বিপরীতে বেড়েছে ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অর্থনৈতিক মন্দায় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ কম নেওয়া এবং বেসরকারি খাতে ঋণ কম বাড়ায় মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। 

কারণ, মন্দা ও ডলার সংকটে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেমন কম ছিল, তেমনই বেসরকারি খাতেও চাহিদা ছিল কম। ডলার সংকট, বৈশ্বিক মন্দা ও চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি রয়েছে। যে কারণে তারাও হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন। 

আগের অর্থবছরের একই সময়ে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছিল সাড়ে ৯ শতাংশের কম। উৎপাদন কর্মকাণ্ড কম থাকার পরও মুদ্রা সরবরাহ আগের অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছরে বেড়েছে। টাকার প্রবাহ বৃদ্ধিসহ পণ্যমূল্য বাড়ায় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার দুই দফা বৃদ্ধি করে গড়ে সাড়ে ৭ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। 

কিন্তু অর্থবছর শেষে জুনে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে। গত আগস্টে এ হার বেড়ে প্রায় ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি চলে গেছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ১২ শতাংশের বেশি। 

যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বর্তমান মূল্য টাকার প্রবাহ বাড়ার কারণে হয়নি। কারণ, টাকার প্রবাহ যেভাবে বাড়ানোর কথা ছিল, সেভাবে বাড়েনি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে টাকার প্রবাহ বেড়েছে কম।

এদিকে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেসব ঋণ নিচ্ছে, এর বেশির ভাগই চলতি ব্যয় মেটাতে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা বাজারে এসে উৎপাদন বাড়াচ্ছে না। এসব অর্থ মূল্যস্ফীতি উসকে দিচ্ছে। অর্থাৎ টাকার প্রবাহ বাড়ছে; কিন্তু উৎপাদন বাড়ছে না।

উৎপাদন খাতে বিশেষ তহবিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব টাকার জোগান দিতে চাচ্ছে, সেগুলোর ব্যবহার কম। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা নিতে হলে নানা নিয়ম মানতে হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো এসব নিয়ম পরিপালন করতে পারে না বলে এ খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থও যাচ্ছে কম। ফলে উৎপাদন খাত আশানুরূপভাবে চাঙা হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের শর্ত অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বছরে দুই দফা মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে। মুদ্রানীতিতে বিভিন্ন খাতে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সেগুলো অর্জিত হচ্ছে না। এদিকে সরকার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণ করে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণই বেশি নিয়েছে গত অর্থবছরে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। বেসরকারি খাতে চাহিদা কম।

গত অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। বিতরণ করা হয়েছে ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। সরকারি খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্জিত হয়েছে ৩৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। 

আলোচ্য সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট ছিল। যে কারণে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ কমিয়েছে। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ শোধ করেছে। যে কারণে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ কমেছে। 

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ বেড়েছে। ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পদক্ষেপ নিয়েছে। বেসরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্জিত হয়েছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৬ শতাংশ বাড়ানো হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে আদায় বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এতে ঘাটতি হওয়ায় সরকারকে ঋণের ওপর ভর করতে হয়েছে। রাজস্ব আয় কম হওয়ায় এবং ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকায় সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ঋণ নিতে হয়েছে।

এদিকে ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার মান কমে যাচ্ছে। শুধু ডলারের হিসাবেই এক বছরের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ১৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ২০২২ সালের জুনে ডলারের দাম ছিল ৯২ টাকা। গত জুনে তা বেড়ে ১০৮ টাকা ৩৫ পয়সা হয়েছে। 

গত দেড় বছরে ২৮ শতাংশ কমেছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। আমদানি পণ্যেও দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor