Bangladesh

ছোট্ট নাঈমের কাঁধে পাহাড়সম সংসার

‘যাত্রী ওঠা, যাত্রী ওঠা; সিট খালি আছে। দরজায় ভিড় কইরেন না, ভিতরে যান, পিছনে গিয়া বহেন, তিনটা সিট আছে। আপনারা এমনে খারাইলে লোকজন যাইব ক্যামনে?’ কচিকণ্ঠে কথাগুলো শুনে অবচেতনে বক্তাকে খুঁজতে লাগলাম। পেছনে ঘুরতেই বাসের দরজার পাশের সিটে গা এলিয়ে বসে থাকতে দেখলাম এক শিশুকে। সম্প্রতি ব্যাংকের একটি কাজে রাজধানীর বনশ্রী গিয়েছিলাম। ফেরার পথে স্বাধীন পরিবহনের একটি বাসে উঠি। প্রথমে সিট খালি না পেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছোট্ট শিশুটিকে দেখলাম। কথা বলার আগ্রহ জাগল। পরক্ষণেই গাড়ির মাঝামাঝি একটি সিট পেয়ে বসে পড়ি। একটু এগোতেই সামনে থেকে এক যাত্রী নেমে যান। তাড়াহুড়া করে গিয়ে ওই শিশুর পাশের জায়গা ফাঁকা পেয়ে বসলাম। 

বাসচালকের সহকারীর (হেলপার) সঙ্গে হাসিমুখে আলাপ করতে দেখে সহযাত্রীর সঙ্গে কথা বলার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। জানতে চাইলামু তুমিও কি এই গাড়ির স্টাফ? খানিক তাকিয়ে জবাব দিলু হ্যাঁ। এখানে তো হেলপার ও চালক উভয়ই আছে, তাহলে তোমার কাজ কী? এবার সামনের কটা দাঁত চিলকিয়ে হাসল, আর বললু আমিও হেলপার। তবে আজ আমার ডিউটি আছে এটা ওই হেলপার জানত না। তাই দু’জনেই ভাগ করে দায়িত্ব পালন করব। আর কিছুদূর গেলে আমি দরজায় দাঁড়াব। 

একটু সোজা হয়ে বসল নাঈম। তার মুখ থেকে গড়গড়িয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল অনেক কথা। এবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নামটা জানতে পারি? জবাবে বললু মোহাম্মদ নাঈম। সে জানাল, তার গ্রামের বাড়ি ভোলার চরফ্যাসনের মেঘভাষাণ চরের নূরাবাদে। সেখানে তার তিন ভাই ও বাবা-মা থাকে। নাঈম ঢাকার মোহাম্মদপুরের বোডঘাট এলাকায় তার এক খালাতো বোনের বাসায় থেকে বাসে হেলপারি করে। তার ভগ্নিপতিও চালক। তিনি একজনের প্রাইভেটকার চালান। ওই বাসায় সে পেয়িংগেস্ট হিসেবে থাকে। 

কথা বলে জানা গেল, নাঈমের বয়স ১৩ বছর। চার ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। পড়ত চরফ্যাসনের নূরাবাদের আহমেদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তার বাবা মোহাম্মদ খোকনের পেশা মাছ শিকার। অন্যের ট্রলারে থেকে মাছ ধরার দলে কাজ করেন তিনি। তাঁর আয়ে টেনেটুনে সংসার চলে যাচ্ছিল। বছর কয়েক আগে তাঁর হার্টে সমস্যা ধরা পড়ে। এরপর থেকে এই রোগ সংসারে ব্যয়ের অন্যতম প্রধান খাত। তিনি মাঝেমধ্যে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন, যেতে পারেন না মাছ ধরতে। আবার এখন আর আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না। সবমিলিয়ে সংসারের চাকা থমকে যায়। স্ত্রী-সন্তানের জন্য তিনবেলা খাবার জোটানোই কঠিন হয়ে পড়ে। খেয়ে না খেয়ে স্কুলে যেতে পারত না নাঈম। সহ্য হতো না আহারের জন্য ছোট ভাইদের কান্না, বন্ধ করে স্কুলে যাওয়া। এ অবস্থায় মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন তার মা। আরও অসহায় হয়ে পড়ে ছোট্ট নাঈম ও তার ভাইয়েরা। দিনের অধিকাংশ সময় ছোটদের দেখাশোনা ও বাবার সেবাযত্ন করতে হতো নাঈমকে। তাই এ বছর অষ্টম শ্রেণিতে উঠলেও আর এগোতে পারেনি। মাকে বাইরে কাজ কমিয়ে বাড়িতে বেশি করে সময় দেওয়ার কথা বলে কয়েক মাস আগে চলে আসে ঢাকায়। 

শিশুটির মা নূরজাহান বলেন, নাঈমের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসার চালাতে একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছি। সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। গাঙে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। এই দুর্মূল্যের বাজারে খেয়ে না খেয়ে আর কতদিন বাঁচা যায়। তাই বাধ্য হয়ে কাজে নেমেছে নাঈম। 

এতটুকু বয়সে বাসের হেলপারি করার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে নাঈম বলে, ড্রাইভারসহ বাসের অন্য স্টাফরা আমাকে খুব আদর করে। অনেক সময় যাত্রীরা ভাড়া নিয়ে ঝামেলা করেন। কেউ কেউ সঠিক ভাড়া দিতে চান না। তাদের কিছু বললেই ধমক দেন, মারতে আসেন। কয়েকজন চড়থাপ্পড়ও দেন। আমি তো ছোট, তাই নীরবে সহ্য করি, আর কিছুক্ষণ কেঁদেই ভুলে যাই। কাজটা তো করতেই হবে, নইলে বাড়িতে ওরা খাবে কী? 

পড়ালেখার ইচ্ছে করে কিনা, জিজ্ঞেস করতেই চোখ ছলবল নাঈমের। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নামতেই মুছে নিল, আর বলল, এই বাসেই প্রতিদিন কতজন স্টুডেন্ট বলে ভাড়া কম দিয়ে যাতায়াত করে। কিন্তু শুধু কয়টা টাকার জন্য আমি পড়তে পারলাম না। যখন কোনো স্কুলের সামনে দিয়ে যাই, আর দেখি শিক্ষার্থীরা সুন্দর সুন্দর জামা পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ছোটাছুটি করছে, তখন কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। আব্বুর টাকা থাকলে আমিও পড়তে পারতাম। 

গাড়িতে থেকে আয়-ইনকাম কেমন হয় জানতে চাইলে নাঈম বলে, এক দিন পরপর গাড়িতে ডিউটি পড়ে। যাত্রী পাওয়ার ওপর ইনকাম। সে হিসাবে দৈনিক আটশ থেকে বারোশ টাকা আসে। এখান থেকে খাওয়া ও থাকার খরচ বাদে বাকি টাকা মায়ের কাছে পাঠাই। মা নিজেও মানুষের বাড়িতে কাজ করে, এভাবেই কিস্তি দেয় আর সংসার চালায়। 

আহমেদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, কী আর বলব; অগ্নিমূল্যের বাজারে আমরাই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। সেখানে উপকূলীয় এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা আরও নাজুক। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। শুধু অষ্টম শ্রেণিতেই এ বছর ৪০ জনের মতো ছাত্রছাত্রী স্কুল ছেড়েছে বলে আশঙ্কা করছি। এভাবে ২০২০ সালের পর থেকে প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করছে। পরিবারের দৈন্য কাটাতে নাঈমের মতো অনেকেই শিশুশ্রমে নেমে যাচ্ছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেন বলেন, পরিবারের অসচ্ছলতায় নাঈমের মতো অনেক শিক্ষার্থী মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থাভাবে পড়াশোনা এগিয়ে নিতে পারছে না তারা। দুর্গম চরাঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় তাদের সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন করা যায় না।

চরফ্যাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নওরীন হক বলেন, স্কুল থেকে ঝরে পড়া ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে এবং শিশুশ্রম বন্ধে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ আছে। কিন্তু আমাদের কাছে লিখিত আবেদন করতে হবে। তাহলে আমরা সংশ্লিষ্ট শিশুর সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিতে পারব।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button