ছোট ব্যবসার বড় অবদান: অর্থনীতির প্রাণ সিএমএসএমই খাত
উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে প্রাণশক্তি বিবেচনা করা হয় সিএমএসএমই খাতকে। উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবলম্বন তৈরি এবং শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি—সব ক্ষেত্রেই অনস্বীকার্য অবদান রেখে যাচ্ছে সিএমএসএমই খাত। তাই এই খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে লক্ষ্যমাত্রাও। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং মানুষের ভাগ্য বদলে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সিএমএসএমই যারা : কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে গঠিত সিএমএসএমই খাত। সংজ্ঞায়ন অনুযায়ী যেসব পণ্য ছোটখাটো কোনো ঘরের মধ্যে তৈরি করা হয় সেগুলোই কটেজ বা কুটির শিল্প। এতে অনেক বড় মেশিনের ব্যবহার করা লাগে না।
যেমন : তাঁত, মৃৎ, কাঁসা, কাঠ, হস্তশিল্প। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিপুলসংখ্যক কুটির শিল্পের উদ্যোক্তা রয়েছেন। মাইক্রো বা অতিক্ষুদ্র শিল্প হচ্ছে উৎপাদনমুখী যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য যন্ত্রপাতি স্থাপন ব্যয়সহ ১০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকার মধ্যে। এতে শ্রমিক থাকবে একজন থেকে ২৫ জন পর্যন্ত। স্মল বা ক্ষুদ্র শিল্প হচ্ছে উৎপাদনমুখী পণ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য যন্ত্রপাতি স্থাপন ব্যয়সহ ৭৫ লাখ থেকে ১৫ কোটি টাকার মধ্যে থাকবে। এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন ২৬ জন থেকে ১২০ জন শ্রমিক। মিডিয়াম বা মাঝারি শিল্প হচ্ছে উৎপাদনমুখী যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি, কারখানা ভবন ছাড়া স্থায়ী সম্পদের মূল্য যন্ত্রপাতি স্থাপন ব্যয়সহ ১৫ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকার মধ্যে হবে। যেখানে কাজ করবেন ১২১ থেকে ৩০০ জন শ্রমিক। তবে তৈরি পোশাকের প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ এক হাজার জন।
শিল্প ও কর্মসংস্থান : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩-এর পর আর নতুন কোনো তথ্য নেই। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে সব খাত মিলিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৭.৫২ শতাংশ কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান। অতিক্ষুদ্র ১০.৯৯ শতাংশ, ক্ষুদ্র ১.৩৩ শতাংশ, মাঝারি ০.০৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম ০.০৭ শতাংশ বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। সব খাত মিলিয়ে কর্মসংস্থান হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ ৮৫০ জনের। এর মধ্যে সিএমএসএমই কর্মরত রয়েছেন দুই কোটি ১০ লাখ ৩৩ হাজার ৯৯৪ জন। সিএমএসএমই উদ্যোক্তা ৭৮ লাখ ১৩ হাজার ১৩৫ জন। অর্থাৎ ৯৯ শতাংশের বেশি।
অর্থনীতিতে অবদান বাড়ছে : গত চার দশকে দেশের এসএমই খাতের উৎপাদন ক্রমে বেড়েছে। আর গত দুই দশক দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই খাতের অবদান বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ৩৩.৮৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এটি বেড়ে ৩৪.৯৪ শতাংশে দাঁড়ায়। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে উৎপাদন খাত। আর উৎপাদন খাতের মধ্যে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগও অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের শিল্প খাতে সিএমএসএমইর অংশীদারি ছিল ২০.১৫ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে সাময়িক হিসাবে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান বেড়ে ৩৭.৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এতে সিএমএসএমই খাতের অবদানও বেড়েছে। এই সময়ে জিডিপিতে উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ২৪.৯৫ শতাংশ। এর মধ্যে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের অবদান ছিল ৭.৫৭ শতাংশ আর কুটির উদ্যোগের অবদান ছিল ৪.৩৮ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে ১৯৭৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের এসএমই খাতের উৎপাদনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে দেশের এসএমই খাতের উৎপাদন ছিল চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে এসএমই খাতের উৎপাদন দাঁড়ায় ২০ হাজার ৪০ কোটি টাকায়। ২০২০ সাল নাগাদ এটি বেড়ে ৪৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। একইভাবে গত দুই দশকে দেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদানও বেড়েছে। ১৯৯৪ সালে যেখানে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ছিল ২.৫৫ শতাংশ, সেটি বেড়ে ২০২০ সাল শেষে ৩.৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
সিএমএসএমই খাতে অর্থায়ন : নীতিমালায় ২০১৯ এ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ২০২৪ সালে জিডিপিতে সিএমএসএমই খাতের অবদান ৩২ শতাংশে উন্নীত করা। সে লক্ষ্যে এই খাতে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিএমএসএমই নীতিমালা অনুযায়ী ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের প্রত্যেকটি ব্যাংককে তাদের
নিজস্ব বিনিয়োগ পোর্টফোলিওর কমপক্ষে ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। সিএমএসএমই খাতে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের পরিমাণ পুরো দেশে প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে বিগত দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৮৫ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা, যা অর্থনীতিতে এক-চতুর্থাংশ ও বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ অবদান রাখছে।
কী করছে এসএমই ফাউন্ডেশন : ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২২ কোটি টাকা দুই হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষের মধ্যে ঋণ বিতরণ করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় ও পরবর্তী সময়ে সিএমএসএমই খাতে নেতিবাচক প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। তখন এসএমই ফাউন্ডেশন ক্রেডিট হোলসেলিং মডেল ব্যবহার করে ১৯টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিন হাজার ১০৮ জন উদ্যোক্তাকে ঋণ দেয়। তাঁদের মধ্যে বিতরণ করা হয় মোট ৩০০ কোটি টাকা। ঋণ পাওয়া উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৭৩৬ জন নারী ও দুই হাজার ৩৭২ জন পুরুষ। জনপ্রতি গড় ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই হাজার ৯৭৮ জনকে দেওয়া হয় আরো ৩০০ কোটি টাকা। ফলে এখন পর্যন্ত এসএমই ফাউন্ডেশন আট হাজার ২০০ উদ্যোক্তার মধ্যে বিতরণ করেছে ৭২২ কোটি টাকা।
এই খাতের উন্নয়নে করণীয় : এসব উদ্যোক্তার বেশির ভাগই আনুষ্ঠানিক ব্যবসা করেন না। এতে তাঁরা একদিকে সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। অন্যদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এই খাতে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন। তাহলে তাঁদের আনুষ্ঠানিক ব্যবসার মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘জিডিপির চেয়ে কর্মসংস্থানে সিএমএসএমই খাত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ছোট ছোট উৎপাদন জিডিপির বিচার অনেক বড় কিছু নাও হতে পারে, কিন্তু অনেক মানুষ অন্তত কিছু করে খেতে পারছেন। সে জন্য অর্থনীতিতে এই খাতের বিশাল অবদান।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই খাতের চ্যালেঞ্জের মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া অনেক বড় সমস্যা। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়াও সমস্যা। এগুলোর মূল কারণ হচ্ছে প্রক্রিয়াটা এসএমইবান্ধব হয়নি। সিএমএসএমই বিশেষ করে কুটির ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নীতি অন্যদের চেয়ে আলাদা হতে হবে। মাঝারি থেকে কুটির ও অতিক্ষুদ্রকে আলাদা করতে হবে। একটি নির্ধারিত পরিমাণের মধ্যে যাঁদের লেনদেন তাঁদের ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া খুবই সহজ করা দরকার। সুদের হারও সহজ হওয়া দরকার। তাঁদের মধ্যে যারা নতুন, ছোট তাঁদের গড়ে ওঠা ও ঋণের ব্যাপারে সহজ করে দেওয়া দরকার। কারণ তাঁরা ঋণখেলাপি হলে কত টাকা হবেন? ট্রেড লাইসেন্সের ক্ষেত্রে এক বছরের একটা শিক্ষানবিশ লাইসেন্স দেওয়া যেতে পারে। কারণ অনেকে নিশ্চিত থাকে না যে ব্যবসা করবেন কি না। এক বছর পর অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে আসতে বললে নতুন উদ্যোক্তারা আগ্রহী হবেন। উদ্যোক্তারা অনেক সময়ই জানেন না যে কোথায় গেলে ব্যবসার কী ধরনের তথ্য পাবেন। যেমন অনেকে ক্ষুদ্রঋণের দিকে যায়, যেখানে সুদের হার অনেক বেশি। এ জন্য ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে উদ্যোক্তাদের তথ্য দেওয়ার জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। মানে ব্যবসার শুরু থেকে পণ্য বিক্রি করার সব তথ্যের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে তাঁরা ব্যবসা শুরু ও পরিচালনা করতে সফল হবেন।’