জটিল হিসাব ডাকসু নির্বাচনে শেষ মুহূর্তের কৌশল নিয়ে ব্যস্ত প্রার্থীরা

রাত পোহালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শেষ হয়েছে গতকাল। শেষ মুহূর্তে কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত প্রার্থীরা। ৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ডাকসু নির্বাচন রাজনৈতিক দল ও পক্ষের জন্য এসিড টেস্ট হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচন আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য ডাকসু নির্বাচন একটি বার্তা হতে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন।
ওদিকে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ভোটের হিসাবও জটিল হয়ে উঠছে। প্রার্থীরা নিজেদের সমর্থন আদায়ে নানা কৌশলে চেষ্টা করছেন। নানা হিসাবনিকাশ থাকায় ভোটের অঙ্কটা অনেক জটিল হয়ে উঠেছে। নির্বাচনে কার কী অবস্থান হবে এ নিয়ে আগে থেকে বড় কোনো পূর্বাভাসও মিলছে না। এ কারণে সব প্রার্থীই সমানভাবে মাঠে সক্রিয়। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও সব প্রার্থীই মাঠে রয়েছেন।
এবারের ভোটের ১৩ দিনের প্রচারণায় দেখা গেছে সৃজনশীলতা-কৌশল। এবার সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন প্রার্থী ও ভোটাররা। প্রচারণায় তাই বাড়তি চেষ্টা দেখা গেছে প্রার্থীদের। টাকা, ডলার, রিয়াল, লিগ্যাল নোটিশ, খাম, মানচিত্র, এটিএম কার্ড, ভিজিটিং কার্ড, হাতপাখা, বুকমার্ক ইত্যাদির আদলে হ্যান্ডবিল, লিফলেট ও পোস্টার ছাপিয়েছেন প্রার্থীরা। এমনকি সিগারেটের প্যাকেটের আদলেও ছিল কার্ড। প্রায় ১৫শ’ প্রার্থী। উৎসবের আমেজে হয়েছে প্রচারণা। হল পাড়াতে এই আমেজ ঢের বেশি। অল্প সময় পরপর ভোটারদের রুমে সদলবলে উপস্থিত হয়ে ভোট চাইতে দেখা গেছে প্রার্থীদের। কেউ কেউ প্রচারণা করেছেন প্যারোডি গানের সুরে সুরে।
শীর্ষ পদের জন্য নেই একক কোনো পছন্দ। ভিপি পদে লড়ছেন ৪৫ জন প্রার্থী। প্রায় প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব কোরাম। তবে এই পদে ভোটের লড়াইয়ে আছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের আবিদুল ইসলাম, ছাত্রশিবির সমর্থিত সাদিক কায়েম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমা, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসসদ সমর্থিত প্রার্থী আব্দুল কাদের, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত বিন ইয়ামিন মোল্লা। আবিদুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট একটা অংশের কাছে পরিচিত। এই প্রার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন এমন ভোটারদের বিপুল অংশকে নিজের পক্ষে আনতে পারবেন কিনা তা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে ভালো অবস্থানে রয়েছেন আবিদুল। তার কোচিং কেন্দ্রিক একটা জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই এখন ভোটার। শিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েমও অনেক চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে এগোচ্ছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কারও কারও মাঝে শিবির নিয়ে অস্বস্তি থাকলেও সাদিক কায়েমের প্রতি আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিশেষ করে নারী-অমুসলিমদের ভোট তার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তারও রয়েছে কোচিং কেন্দ্রিক যোগাযোগ। অন্যদিকে উমামা ফাতেমা সুইং ভোটারদের ক্ষেত্রে এগিয়ে। নারী ভোটারদের ভোট ও অরাজনৈতিক বড় একটি বড় অংশের ভোট আসতে পারে উমামার পক্ষে। শিক্ষার্থীদের মতে এই তিন প্রার্থী মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে পারেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন আলো কেড়েছেন শেষ কয়েক দিনে। তিনিও ইংরেজির শিক্ষক। অরাজনৈতিক ভোটারদের টেনে তিনি নতুন কোনো চমক দেখাতে পারেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
জিএস পদে লড়াইটা হতে পারে মূলত ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের তানভীর বারী হামীম, ছাত্রশিবির সমর্থিত এসএম ফরহাদ, বাগছাস সমর্থিত আবু বাকের মজুমদারের বিরুদ্ধে। তিনজনই ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ। তাদের নিজস্ব ও প্যানেলগত ভোট। তবে রাজনীতির বাইরে ভোট দিতে চাওয়া ও নারীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেতে পারেন ফাতেহা শারমিন এ্যানি। তিনি লড়ছেন ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’র প্যানেল থেকে। এর বাইরে বেশ কিছু নাম পরিচিত হলেও ভোটের লড়াইয়ে তাদের অবস্থান কেমন হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।
কমবেশি অভিযোগ ছিল প্রত্যেক প্যানেলের বিরুদ্ধেই। অভিযোগ থাকলেও অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয় প্রচার প্রচারণা। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ থাকলেও সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন প্রার্থীরা।
নানা রকমের আশ্বাস-ইশতেহারে উঠে এসেছে ক্যাম্পাসের নানা সমস্যা। ডাকসুর অন্তর্ভুক্ত নয় এমন বিষয়ও শোভা পেয়েছে ইশতেহারে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এই শিক্ষার্থীরা সতর্ক। তারা কষছেন হিসাব। বিপুলসংখ্যক অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীর ভোটই মূল পাথেয় এই নির্বাচনের। প্রচারণার শেষ দিনে ছাত্রদল মনোনীত ‘আবিদ-হামীম-মায়েদ’ প্যানেল শপথ পাঠ করেছে। গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে প্যানেলের সব প্রার্থী শপথ পাঠে অংশ নেন। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন কমনরুম সম্পাদক প্রার্থী চেমন ফারিয়া ইসলাম মেঘলা। শপথে তারা প্রতিজ্ঞা করেন ক্যাম্পাস থেকে গণরুম, গেস্টরুম নির্যাতন ও জবরদস্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি চিরতরে বন্ধ করা হবে। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি বৈধ সিট, সাশ্রয়ী খাবার, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেন। তারা আরও প্রতিজ্ঞা করে বলেন, সাইবার বুলিং ও ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে উদ্যোগ নেয়া হবে। শিক্ষা, গবেষণা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে কাজ করবেন তারা। নির্বাচিত হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে প্রতিটি শপথ বাস্তবায়ন করবেন বলে অঙ্গীকার করেন প্রার্থীরা।
নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ নিয়ে শেষ মুহূর্তে তিনটি জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘সোচ্চার’, গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সংগঠন ‘ন্যারেটিভ’, ও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ’ জরিপ চালিয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। দুটিতে ব্যাপক ব্যবধানে জয়ী হতে দেখা গেছে শিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটকে’ একটিতে আছে ২য় অবস্থানে। যদিও এ জরিপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। শিক্ষার্থীদের মতামত নেয়ার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। জরিপ পরিচালকরা বলছেন, মতামত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব রক্ষা করা হয়েছে। এককভাবে কোনো মতাবলম্বী কারও মতামত নেয়া হয়নি। একাধিক স্থান, কাল ও পারিপার্শ্বিকতার ভোটারদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে মতামত। এদিকে প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী এখনো ঠিক করেননি কাকে ভোট দেবেন। অনাবাসিক শিক্ষার্থী প্রায় অর্ধেক। ফলে এই শহুরে মধ্যবিত্ত অনাবাসিক ভোটারদের ভোট কার কাছে যাবে তাই হবে জয়-পরাজয়ের মূল কারণ।
নারীদের ভোটের ক্ষেত্রেও ভিন্ন হিসাব-নিকাশ আছে। নারী ভোটারদের বিরাট অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের দিন হলে থাকবেন না। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় ছুটিতে আছেন বাড়িতে। নারী ভোটারদের প্রার্থীদের বড় অংশ জুড়ে রয়েছেন ভিপিপ্রার্থী উমামা ফাতেমা। ছাত্রদল প্রজেকশন মিটিংগুলো দেরিতে শুরু করায় কিছুটা ভুগতে হতে পারে নারীদের ভোট পেতে। তবে সব দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে। সব দলের প্রার্থীরাই বলছেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। বুথ সংখ্যা, কেন্দ্র সংখ্যা নিয়ে আপত্তি আছে ছাত্রদল, শিবিরসহ সকলের। এদিকে শিবিরের অভিযোগ ছিল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। একটি গোষ্ঠী যখন যা চাইছে তাই হয়ে উঠছে আচরণবিধি।
উল্লেখ্য, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫ আগামী ৯ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যার মধ্যে ভিপি পদে লড়ছেন ৪৫ জন। সবশেষ প্রকাশিত ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে ৩৯ হাজার ৬৩৯ জনের। এবার ডাকসু নির্বাচনে ৮টি ভোটকেন্দ্র ও ৮১০টি বুথ থাকবে।