Bangladesh

জমি অধিগ্রহণের ২০০ কোটি টাকা লোপাট

পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের জন্য মাদারীপুরে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করতে সরকারের বরাদ্দ করা ২০০ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এর মধ্যে সরকারি কর্মচারীও রয়েছেন। শুধু একজন সার্ভেয়ারই পকেটে ভরেছেন ২৫ কোটি টাকা। অধিগ্রহণের টাকা কবজায় নিয়ে হোটেলের সাবেক এক ওয়েটার এখন বিপুল সম্পদের মালিক।
জালিয়াতির শিকার হয়ে জমির অনেক প্রকৃত মালিক টাকা পাননি। ভূমি অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে জাল কাগজ বানিয়ে তাদের অর্থ গ্রাস করেছে ওই চক্র।

জানা গেছে, জমির মালিকদের কাগজপত্রে ত্রুটি থাকলেও তা সমাধান করার প্রলোভন দেখিয়ে এগিয়ে আসে একটি দালাল চক্র। এ জন্য তারা নির্দিষ্ট হারে কমিশন নেওয়ার কথা বলে। পরে ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে জাল কাগজপত্র তৈরি করে অধিগ্রহণের টাকা তুলে নেয়। ওই চক্র খাস জমিকেও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে
দেখিয়ে অর্থ তুলে নিয়েছে। এ চক্রের প্রধান কে এম নাসির ওরফে নাসির কাজী নামে এক তরুণ এখন বিপুল সম্পদের মালিক। ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে বিল।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় ১০ থেকে ১৫টি মৌজার জমি পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। সেসব জমির ক্ষতিপূরণের বিল নামে-বেনামে তৈরি করে দালাল চক্র। সরকারি জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে ব্যক্তিমালিকানার জমি দেখানো হয়। বিল তুলে নিতে দালাল চক্রের সদস্যরা আঁতাত করে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে।

সাবেক জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলামের

সময় ২০২০-২১ অর্থবছরে এ ঘটনা ঘটে। পরের ডিসি ড. রহিমা খাতুনের সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িত ২০ জনের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দেয় জেলা প্রশাসন। ওই চক্রের মূল হোতা নাসির কাজীকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে গত ১৬ আগস্ট এ চক্রের অন্যতম সদস্য হুমায়ুন ঢালীকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তিনি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিকেনগর ইউনিয়নের হাওলাদারকান্দি এলাকার বাসিন্দা। মাদারীপুর পৌরসভার তৎকালীন কাউন্সিলর জাকির হাওলাদারও এ চক্রের সদস্য।
তালিকায় ১ নম্বরে থাকা নাসির কাজী শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের গুপ্তেরচর এলাকার গবাদি পশু চিকিৎসক কাজী মোজাম্মেল হকের ছেলে। স্থানীয়দের তথ্যমতে, তিনি ১০ বছর আগে ঢাকার একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করতেন। পরে গ্রামে এসে তাঁর বাবাকে পশু চিকিৎসায় সহায়তা করতেন। গত ছয়-সাত বছরের মধ্যে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

জানা গেছে, পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে নাসির কাজী দালালি শুরু করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় অন্যের জমি অধিগ্রহণ করা, বিল ছাড়িয়ে আনা, অবকাঠামোর ক্ষতিপূরণের বিল কয়েক গুণ বাড়িয়ে আনাসহ বিভিন্ন কাজের
দালালি করেন তিনি। এক পর্যায়ে গড়ে তোলেন দালাল চক্র। জালিয়াতি করে টাকা তুলে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, সার্ভেয়ারসহ সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুরের তৎকালীন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা প্রমথ রঞ্জন ঘটক, তৎকালীন সার্ভেয়ার মোস্তাফিজুর রহমান, রাসেল আহম্মেদ, মাঈনুল হাসান ও শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক তহশিলদার মাহমুদ বেপারির যোগসাজশে এই অর্থ লোপাট হয়। বিষয়টি নজরে এলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেয় মাদারীপুর জেলা প্রশাসন। তার ভিত্তিতে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দালালদের মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে তৎকালীন সার্ভেয়ার

রাসেল আহম্মেদ ২৫ কোটি ৬৪ লাখ ও আরেক সার্ভেয়ার মোস্তাফিজুর রহমান ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
পরে দুই সার্ভেয়ারকে চাকরিচ্যুত করে ভূমি মন্ত্রণালয়। প্রমথ রঞ্জন ঘটকের বিরুদ্ধে নেওয়া হয় বিভাগীয় ব্যবস্থা। তবে মূল হোতা নাসির রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

দালাল চক্রের কবলে পড়ে ক্ষতিপূরণের বিল না পাওয়াদের মধ্যে একজন শিবচরের হারুন বেপারি। তিনি বলেন, ‘ডাইয়ারচর মৌজায় রেল সংযোগ সড়কে আমার কিছু জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। সেখানে ৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বিল হয় আমার। কয়েক বছর ধরে মাদারীপুর এলএ শাখায় বিলের জন্য ঘুরতে ঘুরতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এক পর্যায়ে শুনি সেই টাকা নাসিরের দালাল চক্রের সদস্য শাহিন বেপারি ওরফে সাহেব বেপারির নামে ভুয়া কাগজ তৈরি করে তুলে নিয়ে গেছে।’
আরেক ভুক্তভোগী খোকন শিকদার বলেন, ‘মাদবরেরচর ইউনিয়নের ডাইয়ারচর মৌজায় আমার ৬৪২ নম্বর দাগে জমি অধিগ্রহণ হলে প্রায় ৬ কোটি টাকা বিল হয়। সেখান থেকে ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা দালাল চক্র তুলে নিয়ে গেছে। এর সঙ্গে সার্ভেয়ার নাসির, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা প্রমথ রঞ্জন ঘটক, দত্তপাড়ার নাসির কাজী জড়িত।’

জানা গেছে, দালাল চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে অর্থের লোভ দেখিয়ে তাদের নামে ভুয়া কাগজ তৈরি করে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিত।
যাদের নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে, তাদের অ্যাকাউন্টে জালিয়াতি করে নেওয়া সরকারি টাকা জমা হওয়ার পরপরই চলে যেত মূল দালাল নাসির কাজীর অ্যাকাউন্টে।

এ বিষয়ে জানতে নাসির কাজীর বাড়িতে গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর বাবা কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘নাসিরের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সে কোথায় আছে, কী করে, কিছুই জানি না।’ তবে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, পরিবারসহ কানাডায় পাড়ি জমাতে নাসির দৌড়ঝাঁপ করছেন।
মাদারীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি ইয়াকুব খান শিশির বলেন, কোটি কোটি টাকা লোপাটে জড়িতরা যেন ক্ষমতা বা টাকার জোরে ছুটে যেতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। জেলা দুদক কার্যালয়ের উপপরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, নাসিরের ব্যাপারে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা প্রশাসক মারুফুর রশিদ খান বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি ও দালালদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে দুদক ও পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করা হয়েছে। আগে দালাল সিন্ডিকেট যেসব অনিয়ম করেছে, বর্তমানে আর তা সম্ভব নয়। এখন আর ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor