Bangladesh

জয়ের চেয়ে বেশি চাপ ভোটার আনা

নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও কেন্দ্রে ভোটার আনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা সাজিয়েছে। দলটির বিশ্বাস, এই পরিকল্পনা কার্যকর হলে বিদেশিদের যে চাপ সেটা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে। এর মধ্যে নিবন্ধিত বেশির ভাগ দলকে নির্বাচনে আনতে পেরেছে। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ফলে জয়ের চেয়ে এখন কেন্দ্রে ভোটার আনার চাপই বেশি।

নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার উপস্থিতি ঘটানোর মিশন চলছে আওয়ামী লীগের। 

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে অনেকটা শীতের রাতের কম্বল টানাটানি করার মতো অবস্থায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। একদিক টেনেটুনে ঢাকার চেষ্টা করলে আরেক দিক ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা এভাবেই সবকিছু সামাল দিয়ে চলেছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। টানাটানি করেই ভোট সম্পন্ন করার অবিচল লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে দলটি। বিএনপিবিহীন ৭ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নহীন করতে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের কাছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোটের প্রচারণা চলবে। এর মধ্যে মাঠে আওয়ামী লীগ ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রচারণায় আছেন। সে তুলনায় অন্য দলগুলোর প্রচার কম। আবার প্রচারে নেমে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। ফলে ভোটের লড়াই নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।

সাত-আট বছর নির্বাচনগুলোতে কেন্দ্রে  ভোটার উপস্থিতি যেভাবে কমেছে, সেটি নির্বাচনকে একধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলেছে; বিশেষ করে গত জুলাইয়ে ঢাকা-১৭ আসনে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ।

এর আগে জানুয়ারি মাসে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৩৮ শতাংশ। গাজীপুরসহ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছিল। এসব ভোটে বিএনপি ছিল না।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোটার উপস্থিতি ঘটানো সম্ভব হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভোট বিতর্ক অনেকাংশে কমে আসবে। তাই ভোটার উপস্থিতির বিষয়ে আগেভাগেই সতর্ক রয়েছে আওয়ামী লীগ। কেন্দ্র থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী যার সঙ্গেই যোগাযোগ করা হচ্ছে, ভোটার উপস্থিতির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘বিদেশি শক্তিগুলোর চাপ ও বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে বদ্ধপরিকর।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি ছাড়া বেশিরভাগ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, আস্থা রেখেছে। বিএনপি এখনো ভোট ঠেকাতে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে চলেছে।’

আওয়ামী লীগের শীর্ষ এই নেতা বলেন, ভোটকেন্দ্রে সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটার উপস্থিতি ঘটিয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট শেষ করতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে আওয়ামী লীগ। ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনতে সব প্রার্থীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ‘অসহযোগিতার’ কর্মসূচি পালন করছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, সর্বোচ্চ ৫০ এবং সর্বনিম্ন ৩৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার চেষ্টায় কাজ করছে আওয়ামী লীগ। দেশি-বিদেশি মহলে নির্বাচনকে প্রশ্নহীন করতে হলে ভোটকেন্দ্রে লম্বা লাইন ঘটাতে হবে। প্রত্যেক প্রার্থীকে প্রচারে গুরুত্ব দিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে টেলিভিশনে-বেতারে ভোটার উদ্বুদ্ধ করতে নানা অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে।

২০০৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ৪৮ শতাংশ ভোট পায়। ওই নির্বাচন ৮৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল। মহাজোটের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যা ৩ কোটি ৪২ লাখ ৭২ হাজার ৯১০। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ ভোট পায়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩২ শতাংশ ভোট নিয়ে বিএনপি পেয়েছে ২৯টি আসন। তারা ভোট পেয়েছে ২ কোটি ৩১ লাখ ৭৮ হাজার ২৬৪টি। বিএনপিরও কয়েকটি মিত্র দল ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পায় ৪০ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোট; অর্থাৎ বিএনপির ভোট কমেছে ৮ শতাংশের কিছু বেশি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা। অন্যদিকে ২০১৮ সালে সব দল নির্বাচনে এলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোট প্রায় ৪০ শতাংশ। দলটির মিত্রদের ভোট ২-৫ শতাংশ। ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ ভোট রয়েছে বিএনপির; অর্থাৎ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভাসমান ভোটার রয়েছে।

ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন নেতা বলেন, ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে, প্রার্থীদের এমন নিশ্চয়তা দিয়ে ভোটারদের আশ^স্ত করতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেক প্রার্থীকে ভোটার উপস্থিতি ঘটানোর জন্য সবার দরজায় বারবার যেতে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্র থেকে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি নির্দেশনা যাচ্ছে ভাসমান ভোটার টানতে। নৌকার প্রার্থীরা বিএনপি বা অন্য দলের ভোটার টানতে না পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অন্য দলের ভোটার টানতে পারবেন বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি আওয়ামী লীগের নির্দেশনার মধ্যে আরও রয়েছে, পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে যেসব ভাসমান ভোটার রয়েছে তাদের প্রতি বাড়তি নজর ও যত্ন নেওয়া।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নীলফামারী-১ আসনের নৌকার প্রার্থী আফতাব উদ্দিন সরকার বলেন, বেশ কয়েকবার কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। এ সময় কেন্দ্রীয় নেতারা প্রথমেই কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ভোটার টানার কী কৌশল গ্রহণ করেছেন প্রার্থী, সেটাও অনেক কেন্দ্রীয় নেতা জানতে চান।

মাদারীপুরের একটি আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা মোবাইল ফোনে নির্বাচনের নানা বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। কিছু পরামর্শও তাকে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

স্বতন্ত্র এই প্রার্থী আরও বলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা তাকে নির্দেশনা দিয়েছেন, শুধু আওয়ামী লীগের ভোটারের দিকে লক্ষ থাকলে জেতা কঠিন হবে। তাকে অন্য দলের অন্তত ১০ শতাংশ ভোট যোগ করতে হবে। অথবা ভাসমান ভোটারকে কেন্দ্রমুখী করতে হবে।

সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে অনড় আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত ২৬টি দলকে নির্বাচনে আনতে পেরেছে। নিবন্ধিত এতগুলো দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিদেশিদের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ সামলে নিতে পারবে মনে করে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। এসব দলের সম্মিলিত ভোট ১০ শতাংশেরও কম। ফলে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির প্রত্যাশা পূরণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ক্ষমতাসীনরা।

আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, ভোটার উপস্থিতির দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠতে পারলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগও আর পাবে না দেশি-বিদেশি মহল। সমালোচনা সামলাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে নামিয়ে দিলেও কোনোভাবেই আশাবাদী হয়ে উঠতে পারছে না আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলেন, ভোটার উপস্থিতির দুশ্চিন্তা থেকেই প্রার্থীদের কেন্দ্রে ভোটার টানার চাপই বেশি দিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ।

ঝালকাঠি-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগ নেতা) মনিরুজ্জামান মনির বিশ্বাস, তার আসনের সব ভোটকেন্দ্রে ভোটারের দীর্ঘ লাইন থাকবে। তিনি বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা তাকে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের ভোটও তিনি বেশি পাবেন দাবি করে এই স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন, বিএনপির সাধারণ ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে আসবেন। এই আসনে সদ্য বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। তিনিই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আসনটিতে ভোট করছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d