Bangladesh

জয়ের নিশ্চয়তা চায় জাপা, চাপে রাখছে আ’লীগ

ফের প্রধান বিরোধী দল হতে চাওয়া জাতীয় পার্টি (জাপা) ভোটে থাকতে ‘সম্মানজনক’ সংখ্যক আসনে জয়ের নিশ্চয়তা চায়। জাপা নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্দেহ করলেও, দলটির সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। আসন সমঝোতার কথা অস্বীকার করলেও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দুই দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা গতকাল মঙ্গলবার রাতেও গুলশানের একটি বাড়িতে বৈঠক করেন। কী আলোচনা হয়েছে, জানাননি তারা। তবে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, সমঝোতা এবং আসন বণ্টনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

নৌকা ও ‘আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী’ সরিয়ে ৪১ আসন ছাড়লেই সন্তুষ্ট জাপা। স্বতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হলে তারা চাইছে অন্তত ৬০ আসন। তবে এত আসন ছাড়তে নারাজ ক্ষমতাসীনরা জাপাকে রেখেছে পাল্টা চাপে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের গতকালের বৈঠক এ চাপেরই অংশ।

জাপা সূত্রের মূল্যায়ন, এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে– আসন সমঝোতা নিয়ে অসন্তোষ বা অন্য কোনো কারণে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের সরে গেলেও রওশনের নেতৃত্বে দলটিকে নির্বাচনে রাখা হবে। যেভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জাপার প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বর্জন করলে দলের একাংশ রওশনের নেতৃত্বে অংশ নিয়েছিল।

অনুসারীদের মনোনয়ন না দেওয়ায় নির্বাচনে নেই রওশন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেন, জি এম কাদের ‘ক্যু করে’ জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দখল করেছেন। জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন ‘খণ্ডিত জাপা’র সঙ্গে নির্বাচনী জোট না করতেও আওয়ামী লীগ সভাপতিকে অনুরোধ জানিয়েছেন রওশন।

রওশনকে মনোনয়ন দিতে রাজি থাকলেও তাঁর ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদের আসনে প্রার্থী হয়েছেন জি এম কাদের। গত ২৫ নভেম্বর রওশনের বাসায় গিয়ে দেখা করলেও, রংপুর-৩ ছাড়তে রাজি হননি জাপা চেয়ারম্যান। এতে ক্ষুব্ধ রওশন ২৯ নভেম্বর রাতে অনুসারীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।

৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনের আগ পর্যন্ত প্রায় ১৫ দিন চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি রওশন। তাঁর অনুসারীরা সমকালকে বলেন, গণভবনের জরুরি তলবে মঙ্গলবার সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিরোধীদলীয় নেতা। তবে এ বৈঠককে গুরুত্ব না দিয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিরোধীদলীয় নেতা যেতেই পারেন। খুব সহজ বিষয়।’
প্রধানমন্ত্রীর বরাতে দাবি, ছাড় পাবে না জাপা

সাদ এরশাদ দম্পতি ছাড়াও রওশনের সঙ্গে গণভবনে যান বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, জাপার এমপি রওশন আরা মান্নান ও বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদ। তাদের কাউকে মনোনয়ন দেয়নি জাপা। জি এম কাদের সম্পর্কে কুকথা বলে দল থেকে বহিষ্কার হওয়া রাঙ্গা রংপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বৈঠকের বিষয়ে তিনি জানান, রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি আপনার (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে সহায়তা করেছে। এবারও করতে চেয়েছিল। তবে আমি ও আমার লোকজনকে নির্বাচন করতে দেননি জি এম কাদের। তাঁর সঙ্গে সমঝোতা করবেন না।’

মসিউর রহমান রাঙ্গা জানান, প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফরউল্লাহকে নির্দেশ দেন রওশনের অভিযোগ খতিয়ে দেখে এবং আলোচনা করে জাপার সঙ্গে সমঝোতা করতে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দরকার হলে কারও সঙ্গে জোট করব না। সবাই নির্বাচন করে আসুক। যদি আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারে, তখন জোটের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।’ রাঙ্গার এই দাবির বিষয়ে কাজী জাফরউল্লাহর বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। তবে জি এম কাদেরের অনুসারীরা বলেছেন, রাঙ্গার কথা ভিত্তিহীন। প্রধানমন্ত্রী জোট না চাইলে আওয়ামী লীগ আসন বণ্টনের বৈঠক করত না।

বিরোধাদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ বলেছেন, ‘রওশন এরশাদ শুরু থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে। জি এম কাদেরকে একক নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগই স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন আর সন্দেহ করে কী হবে! জি এম কাদের সুযোগ পেলেই নির্বাচন থেকে সরে যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর সন্দেহ সঠিক।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী কথা হলো– গণভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে রওশন এরশাদ গাড়িতে বসে বলেন, ‘এখন তো আর সময় (মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার) নেই। আর কী বলবেন? জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। আমার ছেলের জায়গায় ইলেকশন করছেন। ওর কথা তাঁর মনে নেই। কেন তাঁর প্রতি সমর্থন থাকবে?’ পরে রওশনের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান কাজী মামুন।

বিরোধী দল হওয়ার মতো আসন চায় জাপা
তপশিল ঘোষণার পর গণমাধ্যমের সামনে আসছেন না জি এম কাদের। গতকাল বনানী কার্যালয়ে তিনি দফায় দফায় বৈঠক করেন জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে। এসব বৈঠকে থাকা এক নেতা বলেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক দেখাতে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল ভোটে নৌকা ও লাঙ্গলের প্রার্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে থাকবেন। বিনিময়ে কিছু আসনে জাপাকে জিতিয়ে আনা হবে। তবে পরাজয় নিশ্চিত হওয়ায় এ কৌশলে রাজি হয়নি জাপা।

দলটির চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানিয়েছেন, গতকাল রাতের বৈঠকে আওয়ামী লীগের কাছে দুই প্রস্তাব রেখেছে জাপা। প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী, জাপাকে যেসব আসন ছাড়া হবে সেখানে নৌকা এবং আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটে থাকবেন না। নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে লড়ে জিতে সংসদে গিয়ে ফের প্রধান বিরোধী দল হবে জাপা। এ ক্ষেত্রে ৩৫টি আসনে ছাড়লেই হবে।

নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী সরানোর দায়িত্ব নিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। গতকালও শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দিতে পারে না আওয়ামী লীগ। গতকাল রাতের বৈঠকেও একই কথা বলেন।

জাপার দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো, ৬০ আসন ছাড়তে হবে। যেখানে নৌকা না থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা থাকবেন। তাদের বিরুদ্ধে লড়ে জাতীয় পার্টি অন্তত ৩০ আসন জিতে প্রধান বিরোধী দল হবে। জাপা চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক প্রেসিডিয়াম সদস্য এ তথ্য জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগকে ১৪ দলীয় শরিক এবং কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হচ্ছে। তাই আসন সমঝোতায় সময় লাগছে। ক্ষমতাসীনরা জাপাকে ১০ থেকে ১২টির বেশি আসন ছাড়তে রাজি ছিল না। আগের চেয়ে উদারতা দেখালেও শেষ পর্যন্ত কত আসন ছাড়বে, তা গতকালও বলেনি আওয়ামী লীগ।

গতকালের বৈঠকে ওবায়দুল কাদের ছাড়াও ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। অন্যদিকে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চন্নু বৈঠকে ছিলেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার ফের বৈঠক হতে পারে।
আগের দু’বারের মতো গতকালের বৈঠক নিয়েও গোপনীয়তা রাখা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি, কখন কোথায় বৈঠক হয়েছে। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক করার ব্যাপারে উভয় দলই ঐকমত্য পোষণ করেছে। দু’এক দিনের মধ্যে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে।

জাপা প্রার্থীদের দুর্বলতায় আপত্তি আওয়ামী লীগের
জাপা সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ প্রথমে কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত দলগুলোকে প্রধান বিরোধী দল বানাতে চেয়েছিল। তবে দলগুলো বিএনপি নেতাদের ভাগিয়ে নির্বাচনে আনতে না পারায় সে পরিকল্পনা সফল হয়নি। যত সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীই নির্বাচিত হোক না কেন, গুঞ্জন থাকেলও তাদের দিয়ে বিরোধী দল বানাবে না আওয়ামী লীগ। প্রতিবেশী দেশ এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য জাপাকে ফের বিরোধী দল হতে দিতে হবে। প্রতিবেশী দেশের সমর্থনও রয়েছে। তাই জি এম কাদেরের ওপর আস্থা না থাকলেও, তাঁর একক নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

জাপা সূত্রের ভাষ্য, বিরোধী দল বানাতে রাজি হলেও লাঙ্গলের প্রার্থীদের দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগ বেশি সংখ্যক আসন ছাড়তে চাইছে না। গত ৬ ও ৯ ডিসেম্বরের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বরাতে আওয়ামী লীগ নেতারা সে কথাই বলেছেন। তারা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চারটি সংস্থা দিয়ে জরিপ করিয়েছেন। ভোটের মাঠে লাঙ্গলের অবস্থা এতই খারাপ; ক্রেন দিয়ে টেনেও জেতানো যাবে না।’

বৃহত্তর রংপুরের ১০ থেকে ১২টি; ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও বরিশালের একটি করে আসন বাদে আর কোথাও ভোটে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার শক্তি নেই জাপার। ঢাকা-৪ আসনে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এবং নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে লিয়াকত হোসেন খোকা ছাড়া জাপার বাকি এমপিরা আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে সমর্থন দিতে পারেনি। এলাকায় ও রাজপথে শক্তি দেখাতে পারেননি। জাপার কো-চেয়ারম্যানদের অবস্থাও নড়বড়ে। কেউ কেউ চার-পাঁচবার এমপি হলেও জামানত রক্ষার ভোট নেই। তাদের জন্য আসন ছাড়তে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। এতেই আসন সমঝোতা ঝুলে যাচ্ছে।

কী বলছে আওয়ামী লীগ ও জাপা 
জাপার সঙ্গে যোগাযোগের কথা স্বীকার করলেও ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, আসন সমঝোতার কথা হয়নি। কীভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। নির্বাচন থেকে জাপার সরে পড়ার সন্দেহ বিষয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ওই কথা বলেছিলেন।

মুজিবুল হক চুন্নুও বলেন, আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করুক বা সন্দেহ করুক; জাপা নির্বাচনে থাকবে। কেউ যদি এতে অবিশ্বাস করে, তা তার ব্যাপার। নির্বাচনই সরকার পরিবর্তনের পথ। নির্বাচনে বিএনপি নেই। আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট অনেক বেশি। তা পেলে জাপাই জিতবে। জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছে শুধু ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ চেয়েছে। এ দাবি পূরণ হলে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কারণ নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d