জলবায়ু সম্মেলনের ফল নিয়ে সংশয় অনুদানভিত্তিক বরাদ্দের আহ্বান বাংলাদেশের
জলবায়ুকর্মীতে গিজগিজ আজারবাইজানের বাকু। শেষ সময়ের প্রতিক্ষণই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখনও জলবায়ু সম্মেলনের পরতে পরতে সংশয়, সন্দেহের মাখামাখি। অর্থায়ন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় ছড়িয়ে পড়েছে হতাশা। এ পরিস্থিতিতে ১১ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া সম্মেলনের পর্দা নামার কথা রয়েছে আজ শুক্রবার।
সম্মেলনের মূল লক্ষ্যই ধনী রাষ্ট্রের কাছ থেকে দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের জন্য অর্থের সংস্থান করা, যাতে উষ্ণায়নের ছ্যাঁকা থেকে সবাই বাঁচতে পারে। তা হবে কি? প্রশ্নটা ঝুলে রয়েছে। বেশ কয়েকটি সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রাপ্য জলবায়ু ফান্ডের অর্থ ছাড় দেওয়া নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের চাপে রাখতে শেষবেলায় এসেও বিক্ষোভ করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও চেয়েছে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। আন্দোলনকারীরা বলছেন, সবুজ পৃথিবী গড়তে অবশ্যই অর্থ ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে এই সুন্দর পৃথিবী ধ্বংসের দিকে যাবে।
অবশ্য গতকাল জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থা সম্মেলনে নতুন প্রস্তাব প্রকাশ করেছে। দরিদ্র দেশগুলোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ধনী দেশের সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণের একটি পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে এ প্রস্তাবের মাধ্যমে। তবে আলোচনা এখনও ধীরগতিতে চলছে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো এখনও গৃহীত হয়নি। প্রস্তাবের সর্বশেষ খসড়াটি নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা পরে উপস্থাপন করা হয়। সম্মেলন শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া বাকি। বার্ষিক অর্থ সহায়তা কীভাবে হিসাব করা হবে, কে কত টাকা দেবে এবং এ অর্থের উৎস কী হবে– এগুলো এখনও নির্ধারণ হয়নি। ফলে এবারের সম্মেলন সময়মতো শেষ করা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। আর্থিক বিষয় নিয়ে দরকষাকষি চলার মাঝেই শোনা যাচ্ছে, কপ২৯-এর সময় বাড়তে পারে। অবশ্য ২৮ বছরের ইতিহাসে কালেভদ্রে কপ সম্মেলন নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়েছে।
এবার জলবায়ু সম্মেলন শুরুর আগেই আয়োজক দেশ আজারবাইজানের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। আজারবাইজান এমন একটি দেশ, যার রাজস্বের প্রায় ৬০ শতাংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতাসীন হওয়া জলবায়ু সম্মেলনে বড় নেতিবাচক পরিস্থিতির জন্ম দিলেও বাকুতে একের পর এক বৈশ্বিক নেতার অনুপস্থিতির খবরও হতাশা ছড়িয়েছে। করপোরেট কোম্পানির আনাগোনা, জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির লবিস্টদের আধিপত্যসহ নানা কারণে শুরুতেই এ সম্মেলন থেকে খুব বেশি আশাবাদ তৈরি হয়নি। শেষ মুহূর্তে অর্থায়ন তহবিলেই আটকে আছে সবকিছু।
বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের মধ্যে বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতার দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। জলবায়ু সংকটের জন্য মূলত দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি। কপ সম্মেলনে এ জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রগুলো।
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের জলবায়ু কূটনীতির বিশেষজ্ঞ লি শুও বলেছেন, আমরা এখনও সমাধান থেকে অনেক দূরে আছি। নতুন অর্থনৈতিক খসড়া দুটি জলবায়ুর ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের আলোচনায় অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে অন্তত ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। ১০ পৃষ্ঠার খসড়া নথিতে এসব ইস্যুতে আগে থেকেই বিদ্যমান উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বিরোধপূর্ণ অবস্থানগুলো তুলে ধরেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ দাতা দেশগুলো জানিয়েছে, তারা অর্থের কাঠামো ও অন্যান্য ইস্যু সুস্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত কতটা অর্থ দেওয়া সম্ভব, তা প্রকাশ করতে চায় না। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে তহবিল নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত। এই তহবিলের প্রকৃতি, পরিমাণ ও উৎস নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া কপ২৯ সম্মেলনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আসেনি
সম্মেলনে কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার আসেনি। সম্মেলনের নবম দিনে ‘এশিয়া ক্লাইমেট সলিউশনস’ প্যাভিলিয়নে অনুষ্ঠিত ‘ক্লাইমেট সলিউশন ইন ফুড সিস্টেম’ শীর্ষক এক ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল ডিসকাশনে বাংলাদেশের লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, খাদ্য ও কৃষি নিয়ে এমন নীরবতা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা বারবার খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তরের কথা বলছি। একটি ন্যায্য, বৈচিত্র্যময়, জলবায়ুবান্ধব, জনগোষ্ঠীনির্ভর প্রাকৃতিক খাদ্যব্যবস্থা আমাদের গড়ে তুলতে হবে। আমরা এগ্রোইকোলজিকে জলবায়ু দেনদরবারে অগ্রাধিকার দিয়ে যুক্ত করার দাবি জানিয়ে চলেছি। অর্থায়নের ক্ষেত্রে আমরা এগ্রোইকোলজিতে অর্থায়ন নিশ্চিত করে মানুষসহ সব প্রাণীর জন্য খাদ্যব্যবস্থাকে নিরাপদ করতে হবে।
অনুদানভিত্তিক বরাদ্দের আহ্বান বাংলাদেশের
পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গতকাল বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফায়েড গোলস (এনসিকিউজি) আলোচনায় অভিযোজন, ক্ষয়, ক্ষতিপূরণসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে অনুদানভিত্তিক অর্থ বরাদ্দের আহ্বান জানিয়েছেন। এনসিকিউজিবিষয়ক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের বক্তব্যে তিনি ন্যায্য, স্বচ্ছ এবং সমতাভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেন, উদ্দেশ্য নির্ধারণের প্রথম বিকল্পটি এখনও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) বাস্তবতা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় আনেনি, এটি এখনও দুর্বল। অভিযোজন খাতে অন্তত ৫০ শতাংশের বরাদ্দের একটি পরিমাণগত ভাগ নিশ্চিত করতে হবে।
৩ দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে গতকাল নেপাল ও ভুটানের পরিবেশ সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সৈয়দা রিজওয়ানা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা একসঙ্গে কাজ করে সহযোগিতার কার্যকর ধাপ নির্ধারণ করতে পারি। যৌথ উদ্যোগের সম্ভাব্য ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে বিদ্যুৎ, কৃষি, বন এবং নদীর মতো খাতগুলোর ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ খাতগুলো জলবায়ু সহনশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত এবং সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে। কৃষি কোম্পানিগুলোর মিথ্যা সমাধান থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি প্রকৃত অর্থে কৃষক ও সম্প্রদায়কে সহায়তা করতে টেকসই পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
বিদ্যুৎ খাতে আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং নবায়নযোগ্য শক্তি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে নির্গমন কমানোর মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান শক্তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এই রূপান্তর ত্বরান্বিত করতে কৌশল ও পদ্ধতি বিনিময়ের মাধ্যমে জাতীয় ও আঞ্চলিক স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানো যেতে পারে।
উপদেষ্টা আরও বলেন, কমিউনিটিভিত্তিক বীজ ব্যাংক ও সহনশীল ফসলের জাত তৈরির মতো উদ্ভাবনী সমাধান ভাগাভাগি করার মাধ্যমে কম বিনিয়োগে বড় সুফল আনা সম্ভব।