Bangladesh

জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আস্থা, থাকলেও শঙ্কায় আছে রাজনৈতিক দলগুলো

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভেঙে গেছে দ্বাদশ সংসদ। বরখাস্ত করা হয়েছে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের। সিটি করপোরেশন এলাকার মেয়রদের সরিয়ে নিয়োগ করা হয়েছে প্রশাসক। এতে স্থানীয় সরকার কাঠামোতে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা ও অব্যবস্থাপনা দৃশ্যমান হয়েছে। এরমধ্যে আলোচনায় এসেছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়।

ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। একই বক্তব্য এসেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. তোফায়েল আহমেদের কাছ থেকে। এ পরিস্থিতিতে কথা উঠেছে জাতীয় নির্বাচনের আগে কি তাহলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে? নির্বাচন কমিশন কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে?

তবে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদের ভাষ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নির্বাচিত সরকার এসে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে। আগে একবার সেনা সমর্থিত সরকার জাতীয় নির্বাচন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এই সরকারও তেমনটা করলে জনগণের আস্থা হারাবে। সেটা কেন্দ্র করে নতুন কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হবে দেশের।

গত ৬ জানুয়ারি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. তোফায়ে-ল আহমেদও বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন দ্রুত করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তাড়া থাকলেও তৃণমূলের সাধারণ মানুষ স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেও একই রকম মতামত আসছে।

এরপর গত ৮ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে আলোচনার সময় জানান, তার সরকার জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একইসঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে যেন স্থানীয় সরকার সত্যিই স্থানীয় থাকে এবং একটি সরকার নিশ্চিত করা যায়।

স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জনপ্রতিনিধি ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবা দেওয়া যায় না। নাগরিকরা ভোগান্তির শিকার হয়, সময়ক্ষেপণ হয়। এই চ্যালেঞ্জটা আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হলে আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করতে পারব।

কী বলছে রাজনৈতিক দলগুলো

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। বিশেষ করে বড় দল বিএনপি এ ধরনের নির্বাচনের বিপক্ষে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপি। দলটি মনে করে, জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারের উচিত জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া। অন্যদিকে বেশ কয়েকটি ছোট দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, স্থানীয় সরকার তো জাতীয় সরকার না। জাতীয় সরকারের কাছে যত জনগণের প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা থাকে, যত বেশি তারা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হয় যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য। সেটা একটা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে যেমন সম্ভব না, স্থানীয় সরকারের পক্ষেও সম্ভব না। কারণ স্থানীয় সরকারটাও আমাদের সংবিধানে বিপরীতমুখী কথাবার্তা আছে। আর্টিকেল-৫৯ এ আছে স্থানীয় শাসনব্যবস্থা। তার মানে এটা সরকার না, শাসনব্যবস্থা। জাতীয় সংসদ কিন্তু শাসনব্যবস্থা না। তারা আইন প্রণয়ন করবে বাস্তবায়ন করবে প্রশাসন। যে কারণে আমরা জাতীয় নির্বাচনটা আগে চাচ্ছি। এই ভোটের জন্যই কিন্তু এত রক্ত, এত সংগ্রাম। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তো মানুষ অংশগ্রহণই করত না, যেতই না। নমিনেশন পেলেই সে হয়ে যেত। সুতরাং সব বাস্তবতায় সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। 

বাম জোটের শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমাদের বিবেচনায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা এখনকার এজেন্ডা না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগেও তো আমাদের অনেক কিছু সংস্কারের কার্যক্রম করা দরকার। কারণ আমাদের স্থানীয় সরকারগুলো কাজ করতে পারে না। সংসদ সদস্যরা যথাযথ ভূমিকা না রাখার কারণে। এবার আমরা সংসদ নির্বাচনটা করতে পারি ঠিকমতো এবং যতটুকু সংস্কার করে করব আশা করছি তার মধ্যে যদি সংসদ সদস্যের কাজ সুনির্দিষ্ট করে দিতে পারি এবং তারপর যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করি এটা একটা কার্যকর হবে বলে মনে করি।

দ্বিতীয়ত অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা না। তার প্রধান দায়িত্ব জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করা এবং সংস্কারের যতটুকু রূপরেখা তৈরি করা যায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেটুকু করে দিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা মানে এটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করা হলে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হবে। তা সরকারের জন্য বিব্রতকর হবে বলে মনে করি। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন এখনই নয়— আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার কোনো ম্যান্ডেট এই সরকারের নেই। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটা জাতীয় নির্বাচন করা। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত কোনো অন্তর্বর্তী সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় নির্বাচন রেখে এ ধরনের নির্বাচনের আয়োজন করতে চায়নি। সুতরাং এটা করার দুরভিসন্ধি আছে কি না এটা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত সরকারের ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছে কি না? দ্বিতীয়ত সরকার থেকে বিশেষ কাউকে বা কোনো অংশকে বাড়তি কোনো সুবিধা দিতে প্ল্যান করা হচ্ছে কি না? সরকারের এসব ব্যাপারে পথ হারানোর কোনো সুযোগ নেই। তাহলে সরকারের যে মিনিমাম নিরপেক্ষতা সেটা কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা আগে হলে ভালো হয়। কেননা এতে করে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের একটা যাচাই-বাছাই পরীক্ষাও হয়ে যাবে। সরকার ভোটের মাঠ কতটা সামাল দিতে পারবে। আমরা চাই স্থানীয় নির্বাচনটা আগে হয়ে যাক।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ এবং নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে এবং সাধারণ মানুষকে ভোটের উৎসবে যুক্ত করার জন্য জাতীয় নির্বাচন একটা ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। দলীয় সরকারের অধীনে এ যাবৎ যত নির্বাচন হয়েছে প্রত্যেক নির্বাচনে সহিংসতা, মারামারি ও কেন্দ্র দখল হয়েছে। এটা কেউ বলতে পারবে না অমুক সরকারের আমলে এসব হয়নি। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে ভালো দৃষ্টান্ত রাখুক এটা নিয়ে আপত্তি থাকার কথা না। আমরা এটার পক্ষে আছি। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হওয়া উচিত।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে দুটি মত দেখা দিয়েছে। অতীতে একটা প্রমাণক আছে যে, সেনাবাহিনী যখন ক্ষমতা নেয়— যেমন আইয়ুব খানের সময় বা জেনারেল জিয়া অথবা এরশাদের সময় এ ধরনের নির্বাচনের আয়োজন করা হতো। তখন যেহেতু তাদের রাজনৈতিক দল থাকে না। তারা যেটা করেন প্রথমত স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিয়ে থাকেন। যখন প্রার্থীরা নির্বাচিত হন তাদের মধ্য থেকে তারা রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। রাজনীতিবিদদের কাছে এ রকম একটা উদাহরণ আছে। সে কারণে রাজনীতিবিদরা ভাবতেই পারেন অন্তর্বর্তী সরকারের সে রকম কোনো ইচ্ছা আছে।

তিনি বলেন, তবে আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার কিন্তু কোনো সেনা সরকার না। তারা নিজেরা দল করতে চাচ্ছে না। ড. ইউনূস কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে তুলবেন এমনটা মনে হচ্ছে না। যদিও গণ-অভ্যুত্থানের যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা একটা দল গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো ভাবতে পারেন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের যে রাজনৈতিক দল তৈরি হবে সেটাকে সহায়তা করার চেষ্টা হবে। সেটা ভাবতেই পারেন এ ভাবনাটা অমূলক না। কিন্তু অন্যদিকে যদি আমরা চিন্তা করি নির্বাচন সংস্কার যেটা হচ্ছে বা স্থানীয় সরকারের বিষয়ে যে সংস্কার করা হবে যেটাতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবেন সেখানে নির্বাচন আগে হলে আমাদের নির্বাচনী সংস্কারের বিষয়গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে। কোথাও কোনো ঘাটতি থাকলে সেটা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, সেটা হচ্ছে একটা জাতীয় নির্বাচন হওয়ার পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয় তখন যে দল জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে ক্ষমতায় আসে সে দলের পক্ষেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কিছুটা প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা দেখা যায়। যদি স্থানীয় নির্বাচনটা আগে হয় তবে এ প্রভাব থেকে কিছুটা মুক্ত থাকবে।

তিনি বলেন, যেহেতু এ নির্বাচন নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে, তাই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা দরকার। দুই পক্ষেরই বিভিন্ন যুক্তি আছে। তাই উভয় পক্ষকে নিয়ে টেবিলে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. শামছুল আলম সেলিম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে কিছু সংস্কার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। তারা কিন্তু এটাই ওয়াদা করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কারণটা হচ্ছে, তাদের ওপর এ দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধান বিষয়ে কোনো সংস্কার থাকলে, আমলাতন্ত্র নিয়ে কোনো সংস্কার থাকলে, স্থানীয় সরকার নিয়ে কোনো সংস্কার থাকলে, এ কাজগুলো দ্রুততার সঙ্গে করে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করা। অন্য কোনো নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দিলে হবে কী— তখন এই সরকারের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? তাদের নিশ্চয়ই  কোনো উদ্দেশ্য আছে। ওই ধরনের পদ্ধতিতে গেলে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা নষ্ট হবে। এই সরকারের সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে যাবে সবাই।

তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নিয়ে ব্যাপক আকারে উদ্যোগী না হয়ে দ্রুততার সঙ্গে সংস্কার করে সেগুলো নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এগুলো সংস্কার করে এগুলো নিয়ে একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছে সংসদ নির্বাচনটা করতে পারি সেটাই জাতির জন্য মঙ্গল হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button