জাতীয় ফল–ফুলসহ নানা পণ্যের জিআই নিয়ে ঝুঁকি
বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠালসহ নানা পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর এ ঝুঁকি বেড়েছে। এ অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ দুটির অভিন্ন ও সমনামের পণ্য যত দ্রুত সম্ভব জিআই সনদভুক্ত করার তাগিদ অর্থনীতিবিদ, জিআই বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীদের। তবে এসব পণ্য জিআই করার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর গা-ছাড়া ভাব দেখা গেছে।
ভারতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা মহলে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। পরে দ্রুততার সঙ্গে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআইয়ের আবেদন হয় গত মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি)। সেদিনই আবেদন গেজেটভুক্ত করতে বিজি প্রেসে পাঠায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। প্রতিষ্ঠানটি পণ্যের জিআই সনদ দেয়।
জিআই পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ির গেজেট প্রকাশিত হয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারি। গেজেট প্রকাশের পর আইনত দুই মাস অপেক্ষার পর কোনো আপত্তি না এলে এই শাড়ি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
আটটি পণ্য ভারতে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশেও আছে। এগুলোর মধ্যে আছে মালদা ফজলি আম, মালদা লক্ষ্মণভোগ আম, মালদা ক্ষীরশাপাতি, নকশিকাঁথা, বাংলার রসগোল্লা, উপাধা জামদানি, গরদ শাড়ি ও সুন্দরবনের মধু।
অভিন্ন পণ্যে সমস্যা
ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের এমন অনেক পণ্য ও স্থান আছে, যেগুলোর বাংলাদেশের সঙ্গে মিল আছে। এরই মধ্যে আটটি পণ্য ভারতে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশেও আছে। এগুলোর মধ্যে আছে মালদা ফজলি আম, মালদা লক্ষ্মণভোগ আম, মালদা ক্ষীরশাপাতি, নকশিকাঁথা, বাংলার রসগোল্লা, উপাধা জামদানি, গরদ শাড়ি ও সুন্দরবনের মধু।
এমন আরও পণ্য আছে, যেগুলোর এখনো জিআই ভারত করেনি। কিন্তু এসব পণ্য উভয় দেশে আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল, সুন্দরবনের গোলপাতা, সুন্দরীগাছ, নানা ধরনের মাছ, চা, পাট, সাতকরা উল্লেখযোগ্য।
দেশের পণ্যের জিআই নিয়ে গবেষণায় যুক্ত ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি রাজীব আহমেদ বলেন, ‘শাপলা, কাঁঠাল বা পাটের মতো পণ্যগুলো আমাদের জাতীয় প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। এগুলো জাতীয় গর্বও বটে। তাই এগুলোর জিআই যদি বাংলাদেশ প্রথমেই না করতে পারে, তবে তা আমাদের জন্য লজ্জাজনক হবে।’
শাপলা, কাঁঠাল বা পাটের মতো পণ্যগুলো আমাদের জাতীয় প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। এগুলো জাতীয় গর্বও বটে। তাই এগুলোর জিআই যদি বাংলাদেশ প্রথমেই না করতে পারে, তবে তা লজ্জাজনক হবে।
রাজীব আহমেদ, সাবেক সভাপতি, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ
টনক নড়েনি এখনো
দেশে জিআই আইন পাস হয় ২০১৩ সালে। প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পায় জামদানি। পরের ১০ বছরে স্বীকৃতি পায় ১১ পণ্য। আর ২০২৩ সালে এক বছরেই ১০ পণ্যের জিআই স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ।
গত বছর ১০ পণ্যের জিআই সনদের পেছনে অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তাদের সংগঠন ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (ইডিসি) বড় ভূমিকা আছে। জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারের নানা দপ্তর যখন জিআইয়ের গবেষণার কাজে গাফিলতি করছিল, তখন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এ বিষয়ে কাজ করেন ইডিসির সদস্যরা। ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই করার পরও অভিন্ন পণ্য নিয়ে সরকারের দপ্তরগুলোর ঢিলেমি রয়ে গেছে।
এমন আরও পণ্য আছে, যেগুলোর এখনো জিআই ভারত করেনি। কিন্তু এসব পণ্য উভয় দেশে আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল, সুন্দরবনের গোলপাতা, সুন্দরীগাছ, নানা ধরনের মাছ, চা, পাট, সাতকরা উল্লেখযোগ্য।
পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ও দিনাজপুর নামে দুটি জেলা আছে। সেখানকার লিচুও বিখ্যাত। তবে বাংলাদেশের দিনাজপুরের প্রসিদ্ধ লিচুর জিআই এখনো হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে ভারতের আবেদনে বড় ফাঁক হলো, সেখানে টাঙ্গাইল নামে কোনো এলাকা নেই। কিন্তু দিনাজপুরের লিচু নামে যদি ভারতে জিআই হয়ে যায়, তখন জটিলতায় পড়বে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ বলেন, ‘বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জিআইয়ের আবেদনের কিছু কাজ করে ফেলেছি। দ্রুতই আবেদন করা হবে।’
আবার বাংলাদেশ ও ভারত, উভয় দেশের মধ্যে পড়েছে সুন্দরবন। ইতিমধ্যে এ বনের মধু জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করেছে ভারত। কিন্তু সুন্দরবনের আরও অনেক সম্পদ আছে, যেগুলো উভয় দেশেই আছে। যেমন গোলপাতা, সুন্দরীগাছ, নানা ধরনের মাছ। এসব পণ্যও জিআই করার বিষয়ে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ উভয় দেশের অভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে যৌথ মালিকানার বিষয়ে আইন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক চুক্তির আওতায় দুই দেশের সমনামের পণ্যের জিআই নিবন্ধন করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, পণ্যের উৎস ও এর নিবন্ধন নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিসবন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম
সুন্দরবন লাগোয়া জেলা সাতক্ষীরা। এ জেলার প্রশাসন সুন্দরবনের কোনো পণ্যের জিআইয়ের জন্য এখনো আবেদন করেনি। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলছিলেন, ‘সুন্দরবন তো তিন জেলায় পড়েছে। আমরা এখন সমন্বিতভাবে জিআই নিয়ে কিছু করার কথা ভাবছি।’
আর খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, ‘জিআইয়ের বিষয়ে আমরা তো ওপর থেকে আদিষ্ট হয়েই কাজ করি। এখন যে অবস্থা, নিজেদের উদ্যোগেই পণ্যের জিআইয়ের জন্য আবেদনের প্রস্তুতি নিতে হবে।’
ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই করার পরও অভিন্ন পণ্য নিয়ে সরকারের দপ্তরগুলোর ঢিলেমি রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ কী করতে পারে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ উভয় দেশের অভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে যৌথ মালিকানার বিষয়ে আইন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক চুক্তির আওতায় দুই দেশের সমনামের পণ্যের জিআই নিবন্ধন করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, পণ্যের উৎস ও এর নিবন্ধন নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিসবন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভারত কেউই লিসবন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তবে যৌথ মালিকানা পণ্যের বিষয়ে চুক্তিতে যেতে হলে বাংলাদেশের বিদ্যমান জিআই আইন সংশোধন করতে হবে বলেও মত দেন আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব আইনের এই গবেষক তৌহিদুল ইসলাম।