জাতীয় বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দে নিম্নবিত্তরা কতটা সুরক্ষিত
জাতীয় বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের বড় অংশ পাচ্ছে না দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। এ খাতে নগদ ভাতার বরাদ্দ খুবই কম। নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দের তিন ভাগের এক ভাগ সরকারি চাকুরের পেনশন এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের জন্য রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বহুমুখী কর্মসূচি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাখা হয়েছে বড় অঙ্কের টাকা। শিক্ষা খাতের বিভিন্ন বৃত্তি ও উপবৃত্তি এমনকি বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের খরচও সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দের মধ্যেই দেখানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগে থেকেই সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। এর পাশাপাশি সুবিধাভোগী বাছাই প্রক্রিয়ায় গলদ, বাস্তবায়ন পর্যায়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এ কার্যক্রমের প্রভাব প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
গত বৃহস্পতিবার ঘোষিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, যা মোট বাজেটের ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এ বরাদ্দ জিডিপির আড়াই শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের মতো। এ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষায় ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এ খাতে এবার ভাতা বাড়েনি বললেই চলে। তবে ভাতার আওতা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। নগদ সহায়তার মধ্যে শুধু প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা বাড়বে। আর কারও ভাতা বাড়ছে না। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি ১০০ টাকা বাড়ছে। উপবৃত্তি ৯৫০ টাকা থেকে বেড়ে এক হাজার ৫০ টাকা হচ্ছে।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের ৩৩ শতাংশ যাচ্ছে পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে। এর ২৭ শতাংশই খরচ হবে সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের পরিবারের পেনশন বাবদ। এতে ৩৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম বাবদ যাবে আরও ৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা, যা এ খাতে বরাদ্দের ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ দুই খাতে ৩০ শতাংশ বরাদ্দ ছিল।
অর্থনীতিবিদরা অনেক আগে থেকেই সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ থেকে পেনশন এবং সঞ্চয়পত্র বাদ দিয়ে দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করে আসছেন। বাজেটের আগে ঢাকায় আসা আইএমএফের মিশনও একই সুপারিশ করে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুক্তি, সর্বশেষ বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কর্মকর্তার পেনশন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দেখানো হয় না। দশম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীর অধিকাংশই নিম্ন আয়ের। এ বিবেচনায় এসব কর্মচারীর পেনশন সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় দেখানো হয়। অবশ্য পেনশন ব্যয়ের ৮৩ শতাংশ এসব কর্মচারীর পেছনে যায়।
এবারের বাজেট প্রস্তাবে দেখা যায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা এক টাকাও বাড়ছে না। বয়স্ক ভাতা আগের মতো ৬০০ টাকাই বহাল থাকছে। তবে ভাতাভোগীর আওতা বাড়িয়ে নতুন যুক্ত করা হচ্ছে আরও ২ লাখ বয়স্ককে। সব মিলিয়ে নতুন অর্থবছরে এ কর্মসূচির আওতায় ৬০ লাখ মানুষ সুবিধা পাবে। চলতি অর্থবছরে ৫৮ লাখ মানুষকে এ ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির ক্ষেত্রেও ভাতার অঙ্ক আগের মতো রেখে উপকারভোগী বাড়ানো হচ্ছে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ জন। বর্তমানে এ ভাতার পরিমাণ মাসিক ৮০০ টাকা। ১৫ লাখ ৪ হাজার ৮৮০ জন এ সুবিধা পাচ্ছেন। আগামী বাজেটের মাধ্যমে এ কর্মসূচিতে সরাসরি ভাতা সহায়তা পাবেন ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২৮০ জন মা ও শিশু।
বিধবা, দুস্থ ও স্বামী নিগৃহীতদের ভাতাও বাড়েনি। এ ভাতা ৫৫০ টাকাই রাখা হয়েছে। আগামী বাজেটে অবশ্য ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ জন। এই হিসাবে এ কর্মসূচিতে মোট সুবিধা পাবেন ২৭ লাখ ৭৫ হাজার জন। মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও বাড়ানো হয়নি। বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পান। সারাদেশের ১ লাখ ৯২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা এ ভাতা পাচ্ছেন।
সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ভাতা পান হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। তাদের ভাতাও অপরিবর্তিত রয়েছে। যদিও বেদে জনগোষ্ঠীর ১২ হাজার ২২৯ জন নতুন করে আগামী বাজেটের মাধ্যমে ভাতা সুবিধার আওতায় আসছেন। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছর থেকে এ খাতে ৭৭ হাজার ২২৯ জনকে বর্তমান হারে ভাতা দেবে সরকার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরিসি) চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পেনশন এবং সঞ্চয়পত্রের মুনাফা সামাজিক সুরক্ষা বাজেটে আসার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। এখানে এগুলো যুক্ত করাটাই বিভ্রান্তিকর। এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বরাদ্দের বিষয়টি অপরিষ্কার হয়ে যায়। প্রকৃত সামাজিক সুরক্ষার বিষয়গুলো আলাদা বরাদ্দ করে দিলে পরিষ্কারভাবে বোঝা যেত।
ড. হোসেন জিল্লুর আরও বলেন, দরিদ্র শুধু গ্রামে নয়, নগরেও আছে। শহুরে দরিদ্রদের জন্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষা বাজেটে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
সাবেক অর্থ সচিব ও সিএজি মুসলিম চৌধুরী বলেন, বিষয়টি অনেক পুরোনো। সামাজিক নিরাপত্তার সংজ্ঞায়ন কীভাবে করা হচ্ছে, তার ওপর এটি নির্ভর করে। তবে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের পরিবারের পেনশন এবং সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম বাবদ বরাদ্দ সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে দেখানো সঠিক নয়। যদিও দীর্ঘদিন ধরেই তা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারি চাকরীজীবী যে গ্রেডেরই হোক না কেন, তিনি চরম দারিদ্র্যসীমার নিচের কেউ নন। আর সঞ্চয়পত্রের ক্রেতাদের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষ নেই। এর ক্রেতা মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চবিত্ত।
মুসলিম চৌধুরী বলেন, বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ কখনও এগুলোকে সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে ধরে না। বাজেটে দেখালেও তারা হিসাব করার সময় এগুলো বাদ দিয়েই হিসাব করে। তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভাতার পরিমাণ বাড়ানো। অথচ তা করা হচ্ছে না। আওতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাতাও বাড়াতে হবে। বয়স্ক ভাতা ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল চার বছর আগে। তখন মূল্যস্ফীতি কম ছিল। তাই প্রকৃতপক্ষে হিসাব করলে এখন চার বছর আগের সেই টাকা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এগুলো সরকারের বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
উপবৃত্তিতে যা বরাদ্দ
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুটি উপবৃত্তির ১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, স্কুল ফিডিংয়ের ৪৫ কোট ১১ লাখ টাকা, স্কুল মেরামতের ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা, প্রাথমিক স্তরে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের জন্য ৪৪৭ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির বৃত্তির অংশের অর্থ বরাদ্দের ৩ হাজার ৮০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকাও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বাজেটে স্থান পেয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের দুই ক্যাটেগরির বৃত্তির ২ হাজার ৬১৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা, মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালো ফল অর্জনের ৪৪০ কোটি, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশেষ মঞ্জুরির ১০ কোটি এবং মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের জন্য ১ হাজার ১৯৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটিস পরিচালনার বরাদ্দের ১৫০ কোটি টাকাও এ বাজেটে স্থান পেয়েছে।