জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর বৈঠক এনসিসি গঠনে মতবিরোধ

কিছু ভিন্নমতসহ এনসিসির পক্ষে জামায়াত-এনসিপি, বিপক্ষে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল * ঐকমত্য হয়নি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ও জেলা সমন্বয় কাউন্সিল গঠনে * আজকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে আলোচনা
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য তৈরির কথা বলে এনসিসির পক্ষে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। তবে দল দুটি এনসিসির গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু ভিন্নমতের কথা বলেছে। অন্যদিকে এই কাউন্সিল হলে আরও একটি ভারসাম্যহীন অবস্থা হবে-এমন যুক্তি তুলে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল।
বুধবার রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের তৃতীয় দিনের আলোচনার পর সাংবাদিকদের একথা জানান নেতারা। নানা নাটকীয়তার পর কমিশনের এদিনের সভায় যোগ দেয় জামায়াত। তবে ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে আপত্তি তুলে সাময়িক সময়ের জন্য সভা বয়কট করে সিপিবি, গণফোরামসহ কয়েকটি দল।
দিনব্যাপী এ দিনের আলোচনায় বিএনপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। আলোচনার সূচিতে ছিল জাতীয় সংবিধান কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব। এছাড়াও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল গঠন নিয়েও আলোচনা হয়। যা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা তুলে ধরে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে সভায় এ নিয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। আজও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক রয়েছে। অসমাপ্ত আলোচনা সমাপ্তি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দুটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিক দলগুলো অনুভব করে। দু-একটি দলের মধ্যে এ ব্যাপারে নীতিগত মতপার্থক্য থাকলেও একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থার বিষয়ে সবাই মত দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের দুটি প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়েও আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
আলোচনা শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, জবাবদিহি নেই, এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি গণতান্ত্রিক দল হিসাবে বিএনপি সমর্থন জানাতে পারে না। তিনি বলেন, ‘এনসিসিকে সাংবিধানিকভাবে অনেক অনেক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের জবাবদিহি নেই। যদি অথরিটি থাকে, পাওয়ার ফাংশন থাকে, কিন্তু অ্যাকাউন্টিবিলিটি না থাকে, সেই রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমরা গণতান্ত্রিক দল হিসাবে সমর্থন জানাতে পারি না। এই ফাংশনগুলো আলাদা করে আরেকটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করার মধ্য দিয়ে একটা ইমব্যালেন্স (ভারসাম্যহীনতা) সৃষ্ট করা হবে।’
এনসিসির বিষয়ে বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রপতিকে প্রধান করে নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংবিধানিক কাউন্সিলের প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী, উচ্চকক্ষ ও নিুকক্ষের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল কর্তৃক ডেপুটি স্পিকারকে নিয়ে এসসিসি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতির কাছে এই এনসিসির প্রস্তাব করবেন। আমরা এ ধারণার সঙ্গে একমত নই। একটি ভারসাম্যমূলক রাষ্ট্রকাঠামো, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কী করতে পারি, সেটা আমাদের চিন্তা করা উচিত।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে সংসদ-সদস্য পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার ভোট থাকবে, এমন একটি পরিস্থিতিতে এখন নতুন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, বর্তমান সংসদ-সদস্যদের মাধ্যমে এবং উচ্চকক্ষ গঠিত হলে সেখানকার সদস্যদের মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়া উচিত।’
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বর্তমানে প্রচলিত আইনগুলো সংশোধন করে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন, যাতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা যায়।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াতে ইসলামী এনসিসি (জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল) গঠনের পক্ষে। এর মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। তবে এনসিসির গঠন ও আওতা নিয়ে ভিন্নমতের কথা জানান তিনি।
এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে না রাখার পক্ষে মত দেয় জামায়াতে ইসলামী। সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, তিন বাহিনী প্রধানের নিয়োগও এই কমিটির আওতায় না রাখার পক্ষে জামায়াতে ইসলামী। তবে বিষয়টি আরও আলোচনার দাবি রাখে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, তার দল এনসিসি গঠনের প্রস্তাবকে সমর্থন জানায়। তবে গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের দ্বিমত রয়েছে। যারা এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করছেন, তাদের বিকল্প প্রস্তাব পেশ করার আহ্বান জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা জানতে চাই, আপনারা কি আগের ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় থেকে যেতে চান? মানবাধিকার কমিশন থাকার পরও বিগত ১৬ বছরে তারা কোনো কথা বলেনি। দুদক ও নির্বাচন কমিশন তাদের কার্যক্রমে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। কারণ, তারা একটি দল ও ব্যক্তির আজ্ঞাবহে পরিণত হয়েছিল।’ এনসিপির এই নেতা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে এনসিসি গঠনের বিষয়ে মতামত দেওয়ার আহ্বান জানান।
এনসিসি গঠনকে ক্ষমতার ভারসাম্য হিসাবে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগের অসম ক্ষমতা হ্রাস করতেই আমাদের নতুন বাংলাদেশের যাত্রা। তাই আমরা এনসিসি গঠনের পক্ষে মত দিয়েছি। তবে এখানে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। পাশাপাশি এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে রাখা উচিত নয়। এটা নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।’
দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য যেসব কাজ করা দরকার, সরকারকে সেসব বিষয় সম্পন্ন করার জন্য আমরা বলেছি। এনসিসি গঠনের বিষয়ে আমরা ইতিবাচক মত দিলেও বিষয়টি নির্বাচিত সংসদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।’
এই মুহূর্তে সিপিবি এনসিসি গঠনের প্রয়োজন মনে করছে না উল্লেখ করে রুহিন হোসেন বলেন, ‘এটা করা হলে সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার মনে হবে। তবে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় আগামীতে আমরা এটাকে ভাবনায় রাখব। এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন। সেটাকে প্রাধান্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া দরকার।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, এবি পার্টি এনসিসি গঠন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে সম্মত।
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘আমরা এনসিসি গঠনের বিপক্ষে। এই মুহূর্তে এনসিসি গঠনের জন্য সময়ক্ষেপণ করা অপ্রয়োজনীয়।’
সাময়িক সময়ের জন্য সভা বয়কট করে সিপিবি, গণফোরামসহ কয়েকটি দল : বক্তব্য দিতে না দেওয়ার অভিযোগ তুলে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ থেকে বের হয়ে যায় সিপিবি, বাসদ, গণফোরামসহ কয়েকটি দল। তবে কমিশনের সদস্যদের ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের হস্তক্ষেপে ফের সংলাপে ফেরেন তারা। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান হইচই করে সংলাপ বয়কট করে বের হয়ে যান। সে সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এখানে কীসের সংলাপ হচ্ছে, কার সঙ্গে সংলাপ করব। তারা যা ইচ্ছা তাই করছেন। অন্তর্বর্তী সরকার যতদিন নিরপেক্ষ থাকবে না, ততদিনের জন্য আমরা বয়কট করেছি।’ একইভাবে বের হয়ে যান সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ‘বৈষম্য হচ্ছে’ অভিযোগ করে প্রিন্স বলেন, জামায়াতে ইসলামীর তিনজনকে বক্তব্যের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আরও অনেকে বক্তব্য রাখছেন, অথচ আমাদের কাউকে দেওয়া হচ্ছে না। পরে ফের আবার সভায় ফেরে দলগুলো।
সভায় কমিশনের সদস্য হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
বিএনপির সঙ্গে সরকারের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সব দলই কিছুটা বিব্রত-জামায়াত : প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে হওয়া বৈঠককে জামায়াতে ইসলামী স্বাগত জানায়। কিন্তু পরবর্তী যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের সভা শেষে এ প্রসঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের যৌথ সংবাদ সম্মেলন ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এ ঘটনায় দেশের বাকি সব দলই কিছুটা বিব্রত। এখানেই আমাদের আপত্তি ছিল।’ নিরপেক্ষতা হারালে সরকারপ্রধান ও ঐকমত্য কমিশন বেশি দূর এগোতে পারবে না বলে উল্লেখ করেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতের আমিরের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, এরপরে প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামী বুধবারের আলোচনায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।’
হাতে হাত রাখলেন সালাহউদ্দিন-তাহের-নাহিদ : হাতে হাত রেখে পরস্পর সৌহার্দের বার্তা দিয়েছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। কমিশনের আলোচনা চলাকালে বিরতির সময় হাতে হাত রেখে ছবি তোলেন তারা। এ সময় কেমন আছেন নাহিদ-জিজ্ঞেস করেই তাকে বুকে টেনে নেন সালাহউদ্দিন আহমদ।