জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে শিল্প উৎপাদনের বিপত্তির ধাক্কা
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে নেমেছে। প্রবৃদ্ধি কমার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে শিল্প খাত। দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় তিন গুণ। আর শিল্প খাতের উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে দেখা দিয়েছে বড় বিপর্যয়।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক। শিল্প উৎপাদন খাতের এমন বিপর্যয় এর আগে কখনো দেখা যায়নি। মূলত উৎপাদন খাতের বিপর্যয়ের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির এমন বেহাল দশা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিবিএসের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.২৪ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৯.৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৬.৩৯ শতাংশ।
এদিকে অর্থবছরের হিসাবেও অনেক অবনমন হয়েছে শিল্প খাতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে একই প্রান্তিকে ছিল ১৪.৫০ শতাংশ।
অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে ৬.৭৬ শতাংশ। আর দুই অর্থবছরের ব্যবধানে কমেছে ১১.২৬ শতাংশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শিল্প খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি কমেছে উৎপাদন খাতে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে গিয়ে এই খাতে বড় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় প্রান্তিকে উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ০.৪৫ শতাংশ।
অথচ তিন মাস আগেও প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৬০ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই সময় উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৮৮ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১৬.০৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থবছরের শুরুতে ডলার সংকটের কারণে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ বৈশ্বিক সংকটের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে দেশের শিল্প খাতকে। এ কারণে শিল্পের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। পাশাপাশি বৈদেশিক এবং ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমে গেছে। এসব কারণেই জিডিপিতে খাতটির প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমার মূল কারণ হচ্ছে, ডলার সংকটের কারণে আমাদের আমদানি ব্যয় কমাতে হয়েছে। এর ফলে একদিকে উৎপাদন কমে গেছে, অন্যদিকে রপ্তানি আদেশও কমে গেছে।’
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, একদিকে আমদানি ব্যয় কমছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মানেই হচ্ছে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। আর বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান কমে যাবে। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে দেশে বিনিয়োগ আসার পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়েছে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেক কমেছে। বিনিয়োগ কমায় শিল্পের উৎপাদনও কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে শিল্প উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধিতে। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সাধারণত উৎপাদনের প্রধান উপকরণগুলোর মধ্যে অন্যতম ভূমিকায় থাকে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল এবং বিনিয়োগ। এই খাতগুলোর প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরে এই খাতগুলোর প্রবৃদ্ধি তলানিতে নামায় উৎপাদনের ওপর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে শিল্প উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হয়েছে। এ জন্য দায়ী মূলত জ্বালানি খাতের নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি।
বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শিল্প খাতের উৎপাদনের পাশাপাশি তলানিতে রয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের প্রবৃদ্ধি। যদিও প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ০.৩১ শতাংশ, যা এর আগের প্রান্তিকে ছিল ঋণাত্মক ৪৬ শতাংশ। প্রান্তিকের হিসাবে উন্নতি হলেও অর্থবছরের হিসাবে অনেক পিছিয়ে রয়েছে জ্বালানি খাতের প্রবৃদ্ধি। বিবিএসের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪.১৫ শতাংশ, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হয়েছিল ২.৯৯ শতাংশ। সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ০.৩১ শতাংশ। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধিতে অনেক পিছিয়ে।