জিবিএক্স লজিস্টিক্সের হাতে জাদুরকাঠি!

জালিয়াতি ও বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ
টানা ১০ বছর ধরে আয়কর রিটার্ন জমা না দিয়েও সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সেবা ভোগ করছে দেশের একটি বড় কোম্পানি। এক্ষেত্রে তাদের মূল ভরসা ভুয়া আয়কর রিটার্ন সার্টিফিকেট। ভয়াবহ এই জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে কোম্পানিটি রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি দিচ্ছে। দেশের শিপিং ও লজিস্টিক খাতের পরিচিত এই কোম্পানির নাম ‘মেসার্স জিবিএক্স লজিস্টিক্স লি.’। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে অজানা ‘জাদুরকাঠি’র বলে দীর্ঘদিন ধরে এই কারবার চালিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এদের বিরুদ্ধে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগও আছে। যদিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের এই জালিয়াতি ও কর ফাঁকির বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) নজরে এসেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ ও তার স্ত্রী (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) মেরিনা আহমেদের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। যুগান্তরের হাতে আসা নথিপত্র থেকে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত নথিপত্র বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে টানা ১০ বছর আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়া, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নামে আয় দেখিয়ে অর্থ পাচার, দ্বৈত কর আরোপ পরিহার চুক্তির (ডিটিএএ) আড়ালে অবৈধ সুবিধা নেওয়া এবং ভুয়া আয়কর রিটার্ন সার্টিফিকেট ব্যবহার করে সরকারি ও ব্যাংকিং সুবিধা ভোগের মতো পাহাড়সম জালিয়াতির তথ্য মিলেছে।
জানা গেছে, জিবিএক্স লজিস্টিক্সের অন্যতম প্রধান ব্যবসা শিপিং এজেন্সি পরিচালনা। প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রাম কাস্টমসের অধীনে নিবন্ধিত শিপিং লাইসেন্স নম্বর ৩৭১৭/১২। উক্ত লাইসেন্স নবায়নের জন্য কাস্টমস এজেন্ট লাইসেন্সিং বিধিমালা ২০২০-এর ধারা ১৫ অনুযায়ী আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এই নিয়ম না মেনে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। তারা নকল ও ভুয়া আয়কর সার্টিফিকেট জমা দিয়েছে। যা উক্ত লাইসেন্সের নথিতে ৫৮৩ নম্বর নথি হিসাবে সংরক্ষিত আছে। উপ-কর কমিশনার, সার্কেল-৩৫ (কোম্পানিসমূহ), কর অঞ্চল-২ এর দাপ্তরিক তথ্য অনুসারেই, ২০১৫-১৬ করবর্ষের পর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কোনো আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে এই ধরনের গুরুতর জাল ও ভুয়া আয়কর সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে তারা তাদের শিপিং লাইসেন্স নবায়ন করেছে-যা দেশের প্রচলিত কাস্টমস আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ বাতিলযোগ্য এবং ফৌজদারি অপরাধ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার (সভাপতি, লাইসেন্সিং) মো. রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, ভুয়া ডকুমেন্ট দিয়ে লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন অবশ্যই অপরাধ। সাধারণভাবে আমরা জমা দেওয়া তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করেই লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন করে থাকি। তারপরও ভুয়া তথ্য দিয়ে লাইসেন্স নবায়নের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়টি প্রমাণ হলে অবশ্যই লাইসেন্স বাতিলসহ তার বিরুদ্ধে জরিমানাসহ সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বছরের পর বছর আয়কর রিটার্ন কেউ জমা না দিলে কিংবা ভুল তথ্য দাখিল করলে তার দায়বদ্ধতা ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের কাছে। এটা ট্যাক্স অথরিটি যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক কেলেঙ্কারির তথ্য প্রথম ফাঁস হয় ২০১৫-১৬ করবর্ষে। তখন এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) নির্দেশে কর সার্কেল-৩৫ (কোম্পানিসমূহ), কর অঞ্চল-২, ঢাকা একটি বিস্তারিত তদন্তে নামে। সেই তদন্তেই জিবিএক্স লজিস্টিক্স লিমিটেডের বিপুল পরিমাণ আয় গোপনের তথ্য বেরিয়ে আসে। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি তাদের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে শিপিং এজেন্সি কমিশনের বিপরীতে ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর জমার তথ্য দেখিয়ে আয়কর সমন্বয়ের একটি ফাঁকফোকর ব্যবহার করলেও শিপিং এজেন্সি থেকে আয় হওয়া ১২ কোটি ১২ লাখ ৪০১ টাকার বিশাল কমিশন আয় সুকৌশলে গোপন করে। যা ট্যাক্স এসেসমেন্টের ভাষায় অপ্রদর্শিত আয় হিসাবে গণ্য। এর মাধ্যমে তারা কোম্পানির প্রকৃত আয়কে অনেক কম দেখিয়েছে। এর পাশাপাশি, তখন তাদের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া ১৪৭ কোটি ৭১ লাখ ৩৪ হাজার ৪১১ টাকার লেনদেনের তথ্যও তারা গোপন করে। এই বিপুল পরিমাণ করযোগ্য আয় গোপনের দায়ে তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস (ডিসিটি) জিবিএক্স লজিস্টিক্সের ওপর প্রায় ৫৬ কোটি টাকার আয়কর ধার্য করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মালিক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ তখন পতিত সরকারের প্রভাবশালীদের দিয়ে এই টাকা না দিয়েই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।
জানা গেছে, প্রভাবের কারণে রাষ্ট্রের প্রাপ্য বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়লে তখন জনস্বার্থে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন (নম্বর ৯৪২১/২০১৯) দায়ের হলে তড়িঘড়ি করে একটি এসেসমেন্ট করার তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে, পরে এই আয়কর মামলাটি রহস্যজনকভাবে ৫৬ কোটি টাকার পরিবর্তে মাত্র ১২ কোটি ৬০ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩৮ টাকা নির্ধারণ করে নিষ্পত্তি করে কর সার্কেল-৩৫ (কোম্পানিজ), কর অঞ্চল-২। যেখানে বিশাল অঙ্কের আয় গোপন করার মতো গুরুতর এবং প্রমাণিত অপরাধের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটির ওপর কোনো প্রকার জরিমানা বা সুদ পর্যন্ত আরোপ করা হয়নি। এটি এনবিআরের স্বাভাবিক কার্যপদ্ধতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি এবং সরাসরি রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী একটি পদক্ষেপ বলে মনে করেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
আরও জানা গেছে, এই ভয়াবহ অনিয়ম এখানেই শেষ হয়নি। ওই অর্থ পরিশোধ না করে আপিল করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর প্রভাব খাটিয়ে সম্পূর্ণ মামলাটি নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসে। কর সার্কেল-৩৫ এর কর নির্ধারণী আদেশের বিরুদ্ধে আপিল এবং পরবর্তীতে ট্যাক্স আপিল ট্রাইব্যুনালে কিছু অযৌক্তিক, বানোয়াট ও ভুয়া তথ্য উপস্থাপন করে জিবিএক্স লজিস্টিক্স লিমিটেড কোনো প্রকার কর জমা না দিয়েই নিজেদের পক্ষে রায় বাগিয়ে নেয়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, কমিশনার অব ট্যাক্সেস (আপিল) এবং ট্যাক্স আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠানটির দাখিল করা সেসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই (যেগুলো মূল তদন্ত প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট হিসাবে প্রমাণিত) তাদের সব প্রকার আয়কর থেকে অবিশ্বাস্যভাবে অব্যাহতি প্রদান করে। যেখানে তদন্ত প্রতিবেদন এবং উপ-কর কমিশনারের কর নির্ধারণী আদেশে ব্যাংক জমার তথ্য গোপনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল, সেখানে আপিল ও ট্রাইব্যুনাল সেই অকাট্য প্রমাণকে কোনো প্রকার আমলে না নিয়ে একটি দুর্বল ও খোঁড়া আন্তঃপ্রতিষ্ঠান লেনদেনের যুক্তিতে তা খারিজ করে দেয়। অথচ তদন্ত প্রতিবেদনে সুপষ্টভাবে উঠে আসে যে, জিবিএক্সের সর্বমোট ১৯টি ব্যাংক হিসাবের মধ্যে মাত্র ১২টি ব্যাংক হিসাবের বিবরণী জমা দেখিয়েছিল।
নথিপত্রে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্য খাতেও পরিচিত নাম জিবিএক্স লজিস্টিক্স লিমিটেড। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানি হ্যাপাগ-লয়েড, বিএলপিএল লজিস্টিক্স (সিঙ্গাপুর) প্রাইভেট লিমিটেড এবং ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস লাইনের মতো প্রতিষ্ঠানের এ দেশীয় এজেন্ট হিসাবে কার্যক্রম চালায় এই জিবিএক্স। কিন্তু এই পরিচয়ের আড়ালেই চলছিল আর্থিক অপরাধের এক ভয়ংকর খেলা। পতিত আওয়ামী লীগের সাবেক অনেক মন্ত্রী-এমপির বিপুল অর্থও এই কোম্পানির আড়ালে পাচারের অভিযোগ আছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের প্রচলিত নিয়মে ব্যাংক ঋণ, ইন্স্যুরেন্স সুবিধা, ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি, নবায়ন, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং লাইসেন্স, বন্ড লাইসেন্স, চট্টগ্রাম বন্দরে তালিকাভুক্তিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেবার জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিলের হালনাগাদ প্রমাণ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু জিবিএক্স লজিস্টিক্স লিমিটেড আয়কর রিটার্ন দাখিল না করেই ‘জাদুরকাঠি’র বলে বছরের পর বছর ধরে তাদের বিশাল এই ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য পরিচালনা করে আসছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সব নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর উচিত এ বিষয়ে সমন্বিতভাবে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
উল্লিখিত বিষয়ে বক্তব্যের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেরিনা আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্য চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি। প্রতিষ্ঠানটির টিঅ্যান্ডটি নম্বরে কল করা হলেও তা অকার্যকর পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ বিদেশে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। অনেক চেষ্টা করে তার সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।