Hot

জুলাইয়ে বেওয়ারিশ দাফন দ্বিগুণ

ব্যান্ডেজে মোড়ানো পুরো মাথা। সেখানে লেখা– ‘হাড় নেই, চাপ দিবেন না’। কপালেও সাদা ব্যান্ডেজ। বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় উত্তরায় আহত হন তিনি। তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল আগারগাঁও নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে। মাথার হাড় ভেঙে যাওয়ায় ব্যান্ডেজের ওপর লেখা হয়েছিল সতর্কবাণী। গত ২২ জুলাই রাতে হাসপাতালে মারা যান তিনি। পরিচয় না মেলায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে রায়েরবাজার কবরস্থানে।

শুধু এই যুবক নন, গত জুলাই মাসে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে ৮১ জনের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় রায়েরবাজার কবরস্থানে। আগের বা পরের মাসগুলোর গড় বিবেচনায় এই সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি।

শুধু বেওয়ারিশ দাফন দ্বিগুণ নয়, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহেই বেওয়ারিশ লাশ দাফনের সংখ্যা ৪৫। আগস্টে পুরো মাসে এ সংখ্যা ছিল ৩৪ এবং সেপ্টেম্বরে ৩৪ জন। জুনে বেওয়ারিশ দাফন করা হয় ৪৮ জনকে। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসে তারা গড়ে ৩৫-৪০ জনের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেন। কিন্তু জুলাই মাসে সংখ্যাটি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়।

১৬ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর দমনপীড়ন বাড়তে থাকে। ১৮ জুলাই থেকে আন্দোলনে গুলি চালানো হয়। বাড়তে থাকে হতাহতের সংখ্যা।

বেওয়ারিশ লাশ দাফনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে দাফন করা বেওয়ারিশ লাশের বেশির ভাগ আন্দোলনে নিহত হয়েছেন বলে তাদের ধারণা।

জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে যেসব বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে, এর মধ্যে পুলিশ ১২টি মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন করেছে। এগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ছয়টি মৃতদেহে গুলির চিহ্ন রয়েছে। তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। চারজনের শরীরে ক্ষত ও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। একজনের মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। আরেকজন নদীতে পড়ে মারা গেছেন।

মাথার হাড় ভেঙে যাওয়া ওই তরুণের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, ১৯ জুলাই রাত ৮টা ৩৭ মিনিটে জোবায়ের নামে এক ব্যক্তি আহত ওই তরুণকে আগারগাঁও নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ভর্তি করেন।

জোবায়ের গত বৃহস্পতিবার সমকালকে জানান, তিনি নার্সিংয়ের শিক্ষার্থী। উত্তরার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জুলাই তাঁর ডিউটি ছিল। আন্দোলনে গুরুতর আহত হয়ে সেদিন অনেকে হাসপাতালে আসেন। ওই তরুণের মাথার হাড় ভেঙে যাওয়ায় অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তাই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ওই তরুণকে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে রেখে এসেছিলেন।

১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায়ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালানো হয়।

যাত্রাবাড়ী এলাকায় নিহত এক যুবকের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ী থানার দক্ষিণ কাজলা মহাসড়কে আহত অবস্থায় যুবক পড়ে ছিলেন। তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর পেটের ডান ও বাঁ পাশে গুলির দুটি চিহ্ন রয়েছে।

অপর এক লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কাজলা থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২২ জুলাই মারা যান তিনি। তাঁর মাথায় একটি গুলির ছিদ্র ও ডান চোখে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

যাত্রাবাড়ীর আরেকটি লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করেছে, ৩০ বছরের যুবকের লাশের ডান পায়ে দুটি ও পেটের ডান পাশে চারটি গুলির ছিদ্র রয়েছে। পিঠের বিভিন্ন অংশেও ক্ষত রয়েছে। ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ কাজলা থেকে গুলিবিদ্ধ যুবককে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়েছিল।

বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা আরেক লাশের বাঁ চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে সুরতহাল প্রতিবেদনে। ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। অপর এক অজ্ঞাত যুবকও ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাশের বুকের পাশে ও হাতে গুলির চিহ্ন রয়েছে। 

একই সারিতে দাফন, চেনার উপায় নেই

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রায়েরবাজার কবরস্থানে যে ৮১ জনকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়, এর সবই একটি সারিতে খোঁড়া কবরে। আন্দোলনের সময় নিখোঁজ অনেকের স্বজন এখনও যাচ্ছেন কবরস্থানে। কিন্তু কবর শনাক্ত না হওয়ায় অশ্রুসজল চোখে ফিরতে হয় তাদের।

গত ১৯ অক্টোবর কবরস্থান প্রাঙ্গণে বসে কথা হয় কয়েকজন গোরখোদকের সঙ্গে। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কবরস্থানে সব দিনই লোকজনের আসা-যাওয়া থাকে। স্বজনের কবর দেখতে আসেন। তবে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে বেওয়ারিশ লাশের কবর দেখতে আসেন অনেকে। কিন্তু কোনটি কার কবর, তা চেনার উপায় নেই।

কবরস্থানের ড্রেসার রহম আলী ভূঁইয়া সমকালকে বলেন,  ১৮ অক্টোবর চাঁদপুর থেকে এক ব্যক্তি এসেছিলেন ছেলের লাশের কবরের খোঁজে। তিনি তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে ঢাকায় কাঠমিস্ত্রির কাজ করত। থাকত বাড্ডা এলাকায়। আন্দোলনের সময় তাঁর ছেলে মারা গেছে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু লাশ পাননি। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে গিয়ে ছবি দেখে জানতে পারলেন, এই কবরস্থানে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়েছে। ৮১টি কবরের মধ্যে কোনটি তাঁর ছেলের, তা জানার উপাই নেই। তা ছাড়া কবরের চিহ্নও নেই, বৃষ্টির পানির কারণে। কবরের সারি দেখানোর পর তিনি সব কবর ঘুরে দেখেছেন আর চোখের পানি ফেলেছেন।

কখনও কি মিলবে পরিচয়

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ের শেষ ৮ দিনে ওই কবরস্থানে ৪৬ জনের লাশ অজানা হিসেবে দাফন করা হয়, সে সময়টিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হামলা-গুলির ঘটনা ছিল অনেক বেশি। ৪৬ জনের মধ্যে একজন বিদেশি নাগরিকের পরিচয় পরে জানা যায়। বাকি ৪৫ জন অজ্ঞাতই রয়েছেন। ২২ ও ২৮ জুলাই– এই দু’দিনে অজ্ঞাতপরিচয় ২২ জনের লাশ দাফন করা হয়। ২৪ জুলাই  ৯ জন, ২৭ জুলাই ৭ জন ও ২৫ জুলাই ৩ জনের লাশ অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য দিন এক বা দুটি করে লাশ দাফন করা হয়েছে। অজ্ঞাত লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ মর্গসহ কয়েকটি মর্গ থেকে গ্রহণ করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দাফনের ব্যবস্থা করেছিল। মর্গসংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক লাশের শরীরে গুলি ও আঘাতের চিহ্ন ছিল। 

গোরখোদকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর পরিচয় বের করা কঠিন। কারণ কোন কবরে কাকে রাখা হচ্ছে, তা চিহ্নিত করা হয় না। ছবি দেখে বা ডিএনএ মিলিয়ে যদি কখনও পরিচয় বের করা হয়, তখন কবর চিহ্নিত করতে সবার লাশ উঠিয়ে আবার পরীক্ষা করতে হবে। দাফনের সময় ক্রমিক নম্বর বা অন্য কোনোভাবে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা থাকলে পরিচয় মিললে কবর চিহ্নিত করা সহজ বলে তারা জানান।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফনসেবা কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, কে, কীভাবে মারা গেছেন– এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। বেওয়ারিশ হিসেবে আমরা লাশ দাফনের ব্যবস্থা করি।

তিনি বলেন, কোন কবরে কার লাশ, তা চিহ্নিত করে রাখা হয় না। তবে লাশের ছবি তুলে রাখা হয়। পরে ছবি দেখে স্বজন যদি মৃতদেহ শনাক্ত করেন, সে ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নিয়ে লাশ উত্তোলন করতে হবে।

গত ১৯ অক্টোবর রায়েরবাজার কবরস্থানে দেখা যায়, ৪ নম্বর ব্লকে কবরস্থান শনাক্ত করে বাঁশের খুঁটি পুঁতছেন গোরখোদকরা। গোরখোদকদের প্রধান গোলাম রাব্বানী জানান, বৃষ্টির পানিতে কবর সমতল হয়ে যাওয়ায় চেনা যাচ্ছে না।

দেখা গেল, কবরের পাশে বিভিন্ন স্লোগান লেখা ফেস্টুন রাখা হয়েছে। এতে লেখা, ‘বেওয়ারিশ শহীদদের লাশ অতিদ্রুত শনাক্ত করতে হবে’, ‘ফ্যাসিবাদের করালগ্রাস, গুম করে দেয় হাজার লাশ’, ‘শত শহীদের রক্ত বৃথা যেত দেব না’ ইত্যাদি। কবরস্থানে কর্মরত ব্যক্তিরা জানান, ছাত্ররা এসব ফেস্টুন লাগিয়ে দিয়ে গেছেন।
তিনজন গোরখোদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বেওয়ারিশ লাশ বাইরে থেকে কাফন পরিয়ে আনা হয়েছিল। তারা শুধু কবর খুঁড়ে দাফন করতেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে থাকতেন কবরের পাশে। কাফন সরিয়ে লাশের মুখ দেখা নিষেধ ছিল গোরখোদকদের। এর পরও ৪-৫ জনের লাশের মুখ খুলে দেখেছিলেন তারা। এর মধ্যে একজন বয়স্ক এবং বাকি লাশের বয়স ১৭ থেকে ২১ বছরের মধ্যে হবে বলে তাদের ধারণা। 

পুলিশ, ফরেনসিক ও মর্গসংশ্লিষ্টরা জানান, অজ্ঞাত মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট থানার নির্ধারিত পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়। এর পর কোনো স্বজন মৃতদেহ দাবি করলে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে ফরেনসিক বিভাগ তার নমুনা নেয়। পরে উভয়ের ডিএনএ মেলানো হয়। কিন্তু পরিচয় মিললে কবর কীভাবে চিহ্নিত হবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ শাহবাগ থানার আওতাধীন। ওসি খালিদ মুনসুর বলেন, তিনি দেড় মাস এই থানায় যোগদান করেছেন। এই সময়ের মধ্যে অজ্ঞাত লাশের সন্ধানে তাঁর কাছে কেউ আসেনি।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গ পড়ে শেরেবাংলা নগর থানায়। ওসি মোজাম্মেল হক বলেন, জুলাইয়ের অজ্ঞাতপরিচয় লাশের সন্ধানে কোনো স্বজন থানায় এসেছিলেন কিনা, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, অজ্ঞাত সব মৃতদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আশরেফা খাতুন বলেন, শুনেছি, আন্দোলনের সময় কিছু লাশ অজ্ঞাতনামা হিসেবে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এখনও তাদের শনাক্ত করা যায়নি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d