Hot

জুলাই অভ্যুত্থান: হাসপাতালে কাতরাচ্ছে ওরা, মিলছে না অর্থ

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আহত হয়ে রাজধানীর দুই হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১২৭ ছাত্র-জনতা। অসহ্য যন্ত্রণায়
হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন তারা। শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয় বহন করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসপাতালগুলো আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার কথা থাকলেও চিকিৎসা সংক্রান্ত পুরোপুরি খরচ বহন করছে না। অর্থ পেতে জুলাই ফাউন্ডেশনের দ্বারস্থ হয়েছেন অনেকে। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সহায়তা এবং আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে গঠিত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ যথাযথ সহায়তা করছে না বলে অভিযোগ অনেকের। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য কার্ড অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা দিতে বিভিন্ন হাসপাতালগুলো অপারগতা প্রকাশ করছে বলে অভিযোগ তাদের।

গতকাল বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি হাসপাতাল), জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) গিয়ে দেখা যায় জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে এখনো হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে প্রায় দেড়শ’ রোগী। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ৪০০ জনের মতো জুলাই যোদ্ধা এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। অনেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরলেও হাসপাতালের তৃতীয় এবং চতুর্থ তলার ২টি ওয়ার্ডে ৫৫ জন রোগী এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আর নিটোর সূত্র জানায়, সেখানে চিকিৎসা নেয়া ১ হাজার জুলাই যোদ্ধার মধ্যে  ৭২ জন এখনো চিকিৎসাধীন আছেন।

গাজীপুর নাওজোড় কাউন্সিলর অফিসের সামনে গত ৪ঠা আগস্ট পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন টাঙ্গাইলের মধুপুরের বাসিন্দা মো. সোহানুর রহমান। অসুস্থ শরীর নিয়ে ৫ই আগস্ট আবার আন্দোলনে গিয়ে ফের আহত হন তিনি। এরপর সোহানুর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসা নিয়ে গত ৬ মাস ধরে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সোহানুর মানবজমিনকে বলেন, রেডিয়াল নার্ভ সংক্রান্ত কয়েকটি পরীক্ষার জন্য হাসপাতাল থেকে লিখে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমআরআই করার মেশিনসহ কয়েকটি মেশিন নষ্ট থাকায় বেসরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষাগুলো করাতে প্রায় ২২ হাজার টাকা লাগবে। কিন্তু সে টাকা আমার নাই। কারণ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমি। বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘ ৯ মাসের চিকিৎসা শেষে প্রায় নিঃস্ব অবস্থা আমার। তিনি বলেন, আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় এখানকার মেশিন ঠিক হওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ব্যথায় পা নাড়াতে পারছি না। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে শুধু প্রথম ধাপের টাকা পেয়েছি। সোহান বলেন, আমিসহ কিছু জুলাই যোদ্ধা দ্বিতীয় ধাপের টাকার জন্য প্রতিনিয়ত জুলাই ফাউন্ডেশনে বারবার যোগাযোগ করেও আর্থিক সহায়তা পাচ্ছি না। আমি টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছি না। অথচ অনেক ভুয়া আহত বিভিন্নভাবে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে টাকা নিয়ে গেছে। আর আমাদের পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। 

গত ৪ঠা আগস্ট খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের বাসার সামনে গুলিবিদ্ধ হওয়া নাঈম শিকদার নামে আরেক জুলাই যোদ্ধা। তার পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে পিঠ দিয়ে গুলি বের হয়ে যায়। লিভারেও একাধিক গুলি আটকা পড়ে। এক নেভি অফিসারের সহায়তায় চিকিৎসা নিয়ে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে আসেন ঢাকা মেডিকেলে। সেখান থেকে গত ১৫ই মার্চ বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন তিনি। ব্যথায় কাতর নাঈমকে কিছুদিন ধরে উচ্চ নির্ভরতা ইউনিট (এইচডিও) নিবিড় পরিচর্যায় চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। গতকাল বাংলাদেশ মেডিকেলের কেবিন ভবনের ৪ তলায় হুইলচেয়ারে বসে থাকা নাঈমের সঙ্গে কথা হয় মানবজমিনের। তিনি বলেন, আমি চিকিৎসার ব্যয় চালিয়ে নিতে অক্ষম। আমার লিভারে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আমি এই পর্যন্ত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে প্রথম ধাপের টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা পাই নাই। জুলাই ফাউন্ডেশনে গেলে বলে যারা গুরুতর অসুস্থ শুধু তারাই দ্বিতীয় ধাপের টাকা পাবে। আমার শরীরের প্রায় অর্ধেক অংশ গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। পিঠ জুড়ে রয়েছে ক্ষতচিহ্নের দাগ। হাসপাতালের এইচডিও তে চিকিৎসা নিচ্ছি। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকছি। আর কীভাবে আমাকে প্রমাণ করতে হবে যে আমিও গুরুতর অসুস্থ। সহায়তা পেতে আমি গত ৬ই এপ্রিল খুলনা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো সহায়তাই পাচ্ছি না। আমি ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে দ্রুত দ্বিতীয় ধাপের টাকা দেয়ার জোর দাবি জানাই।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মো. সৌরভ ইসলাম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। গত ১৯শে জুলাই মিরপুর-১০ এ ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন সৌরভ। সেই থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য দৌড়াচ্ছেন। কৃষক বাবা একটি জমি বন্ধক দিয়ে ৩ লাখ টাকা জোগাড় করে। গত ৫ই নভেম্বর থেকে নিটোরে ভর্তি তিনি। মানবজমিনের সঙ্গে চিকিৎসা নিতে বিভিন্ন বিড়ম্বনার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন  সৌরভ। গত ঈদে রংপুরে নিজের গ্রামের বাড়িতে গেলে পা ফুলে মারাত্মক ব্যথা অনুভব হয় তার। পরে আবার নিটোরে আসলে ডাক্তার জানান, রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে থেরাপি নিতে হবে। ‘বিম্যাক উইথ পিপিআর মিক্সড সেলুলার থেরাপি’ নেয়াসহ চিকিৎসার জন্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা লাগবে বলে জানান সৌরভ। ঋণগ্রস্ত এ জুলাই যোদ্ধা চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে দ্বিতীয় ধাপের টাকার জন্য গেলে তাকে ১ লাখ টাকার চেক দেয়া হয়। এই টাকা দিয়ে সৌরভের চিকিৎসা ব্যয় মেটানো প্রায় অসম্ভব বলে জানান তিনি। অভিযোগের সুরে মানবজমিনকে তিনি বলেন, গুরুতর আহত বিবেচনায় অনেকে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে কয়েক লাখ টাকা নিলেও, আমাকে শুধু এক লাখ টাকার চেক দেয়া হয়। তিনি ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’কে আরও অধিকতর তদন্ত করে তার চিকিৎসার ব্যয় বিবেচনায় আরও টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করার দাবি জানান। 

সৌরভ বলেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য কার্ড দেয়া হয়। এই কার্ডের আওতায় দেশের সরকারি- বেসরকারি হাসপাতালে গেলে দেয়া হবে চিকিৎসা সহায়তা। কিন্তু আমি ফিজিওথেরাপি দেয়ার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে গেলে তারা জানায় সরকারি স্বাস্থ্য কার্ড সম্পর্কে কিছুই জানেন না তারা। মো. আলমগীর হোসেন নামে আরেক জুলাই যোদ্ধা জানান, রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য গেলে তাকেও একই কথা বলা হয়। তারা সরকারের কাছে এই স্বাস্থ্য কার্ড পুরোপুরি চালু করার দাবি জানান।
বৃহস্পতিবার ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ মানবজমিনকে বলেন, আমরা সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য সহায়তা প্রায় ২৫ কোটি টাকা নিয়ে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। সর্বশেষ অডিট অনুযায়ী আমরা ৭৫০ জন শহীদ পরিবার এবং ৫ হাজার ৯০১ জন আহত পরিবারকে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’- এর পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করেছি। এখনো কিছু আহত যোদ্ধা প্রথম ধাপের টাকা পায় নাই। আমরা চেষ্টা করছি পর্যায়ক্রমে তাদের হাতে সহায়তা তুলে দিতে। এ ছাড়াও গুরুত্ব বিবেচনায় প্রায় ৪০০ জনের মতো আহত জুলাই যোদ্ধাকে দ্বিতীয় ধাপের টাকা দেয়া হয়েছে। আমরা ফান্ড সংগ্রহ করছি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে আবার সহায়তা চাওয়া হবে। আমাদের ফান্ড বৃদ্ধি পেলে অফিসিয়ালি সবাইকে টাকা দেয়া শুরু করবো।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেলের দলনেতা মো. মশিউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমরা জুলাই আন্দোলনের আহত-নিহতদের সরকারি গেজেট অনুযায়ী সহায়তা দেয়া শুরু করেছি। সিরিয়াল অনুযায়ী সবাইকে দেয়া হবে এই সহায়তা। এ ছাড়াও আগামী জুলাই মাসের মধ্যে আন্দোলনের আহত-নিহতদের গেজেট তালিকা অনুযায়ী মাসিক ভাতা দেয়া চালু হবে। 
হাসপাতালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য কার্ড অনুযায়ী সেবা না দেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এই কার্ডের আওতায় দেশের সরকারি- বেসরকারি হাসপাতালে অবশ্যই চিকিৎসা সহায়তা দিতে হবে। যদি কোনো হাসপাতাল চিকিৎসাসেবা না দেয়, আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবো।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d