জেলেদের চালে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছেন জনপ্রতিনিধি
ভোলায় ইলিশ আহরণে নিষিদ্ধ সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের খাদ্য সহায়তা বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিতরণের দায়িত্বে থাকা ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় প্রশাসনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বরাদ্দের অর্ধেকও পাচ্ছেন না ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা। তালিকা প্রস্তুত থেকে শুরু করে চাল বণ্টন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই চলে দুর্নীতি। প্রত্যেক জেলের জন্য সরকার ১৬০ কেজি চাল বরাদ্দ দিলেও কেউই ৬০ কেজির বেশি পান না।
প্রকৃত জেলেদের বাদ রেখে তালিকাভুক্ত করা হয় জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়স্বজন, চাকরিজীবী ও অন্য পেশার মানুষকে। দুর্নীতি ঢাকার জন্য সুবিধাভোগীদের তালিকাও সংরক্ষণ করা হয় না।
সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরি হয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ইচ্ছা অনুযায়ী। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জেলা পর্যন্ত অনেকেই এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় নেই কোনো জবাবদিহি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জেলেদের পরিবর্তে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। ফলে সরকারি সহায়তায় জেলেদের উপকারের পরিবর্তে জনপ্রতিনিধি ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছেন। জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
মেঘনা, তেঁতুলিয়া আর বঙ্গোপসাগর ঘেরা দ্বীপজেলা ভোলায় দুই লক্ষাধিক মানুষ মাছ শিকারে জড়িত। রুপালি ইলিশ ধরাই তাদের আয়ের প্রধান উৎস। তবে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিবছর তিন দফা নিষেধাজ্ঞা জারি করে মৎস্য বিভাগ। পুরো মার্চ ও এপ্রিল, ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিন ও অক্টোবর মাসে ২২ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এতে প্রায় পাঁচ মাস কর্মহীন থাকতে হয় জেলেদের। এই দীর্ঘ সময় কর্মহীন থাকার কারণে দরিদ্র জেলে পরিবারকে চরম অভাব-অনটনে দিন কাটাতে হয়। এসব মানুষের অভাব লাঘব করতে খাদ্য সহায়তা দেয় সরকার।
সরকারি সহায়তা নিয়ে জেলার পাঁচ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ২৩৫ জেলের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এ সময়ের জন্য প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে চার মাসের ১৬০ কেজি চাল সরকার বরাদ্দ দিলেও তা তাদের কেউই পাননি। তাদের মধ্যে দুই মাসের জন্য ৫৫ থেকে ৬০ কেজি করে পেয়েছেন ১২৩ জন, এক মাসের জন্য ৩০ কেজি করে পেয়েছেন ৮১ জন এবং মোটেও পাননি ৩১ জন। মাসে ৪০ কেজি করে বরাদ্দের বিষয়টি তাদের জানা থাকলেও ইউনিয়ন পরিষদের নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না তারা। তাদের আশঙ্কা, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বিরোধিতা করলে চাল তো জুটবেই না, উল্টো নানা হয়রানির শিকার হতে হবে।
জেলেদের অভিযোগ
দৌলতখান উপজেলার ভবানীপুরের মেঘনাপাড়ের বাঁধের বাসিন্দা মো. নাছির জীবিকা নির্বাহের জন্য ৭০ বছর বয়সেও ছেলে মো. হোসেনের সঙ্গে মেঘনায় মাছ ধরতে যান। সরকারি সহায়তার কথা বলতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি। নাছির বললেন, ‘চাউল আইয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বরগো লাইগ্যা। আমগোরে কিছু দিয়া দেহ্যায়। বাকিডা নিজেরা খাইয়া বড়লোক আর দালানের মালিক হয়। কার লগে যুদ্ধ করমু? নামমাত্র যা দেয় তা নিয়াই খুশি থাকত হয়।’ মো. নাছির জানান, তিনি কখনও সরকারের বরাদ্দ দেওয়া ১৬০ কেজি চাল পাননি। চলতি বছর দুই কিস্তিতে ৫০ কেজি চাল পেয়েছেন।
জেলে অধ্যুষিত ভবানীপুর ইউনিয়নের ৭৮ জেলের সঙ্গে কথা হয় খাদ্য সহায়তা নিয়ে। এর মধ্যে ৯ জন এক কিস্তি ও ৬৯ জন দুই কিস্তির চাল পেয়েছেন। ওজনেও কম ছিল। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের জেলে জসিম উদ্দিন দুই কিস্তিতে ৫৫ কেজি চাল পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মুখ চাইয়া চাইয়া নেতাকর্মীরা চাউল দেয়।’ এক কিস্তিতে একই এলাকার মো. ফিরোজ পেয়েছেন ৩০ কেজি। চাল কম পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে কথা কইলে মাইর খাইতে অইব। ঝামেলা বাড়ব।’ ভবানীপুর মাছঘাটে বসে কথা হয় জেলে আবুল কাশেমের সঙ্গে। ১৬০ কেজির পরিবর্তে ৬০ কেজি চাল পেয়েছেন তিনি।
জেলে সহায়তার চাল বিতরণ নিয়ে তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের ১ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৪৬ নিবন্ধিত জেলের সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে এক কিস্তি চাল পেয়েছেন পাঁচজন। পাননি ১৩ জন। বাকি ২৮ জন চার কিস্তির পরিবর্তে পেয়েছেন দুই কিস্তি। চাঁদপুরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মহাজনকান্দির মো. ফারুক জানান, জেলে কার্ডের পরিবর্তে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ‘টোকেন’ এর মাধ্যমে চাল বিতরণ করেছেন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মাওলানাকান্দির মো. হানিফ, মো. সজীব, রফিজল, আব্বাস মাঝি, মিজান, হানিফ, আজগর ও শাহিন স্থানীয় মেম্বারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সরকারি সহায়তা পাননি। হাওলাদারকান্দি গ্রামের বাবুল মাঝি বলেন, ‘মেম্বারের বাসায় গেলে ধমক দেয়।’
সদর উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীপাড়ের ভেদুরিয়া ও ভেলুমিয়া ইউনিয়নের ৬১ জেলের সঙ্গে আলাপ হয়। এর মধ্যে ৫৯ জনই দুই মাসের জন্য ৬০ কেজি করে চাল পেয়েছেন। লালমোহন উপজেলার রমাগঞ্জ ইউনিয়নের ১১ জনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আটজন দুই মাসের ও তিনজন এক মাসের সহায়তা পেয়েছেন। এ উপজেলার বিচ্ছিন্ন চর কচুয়া গ্রামের ১৮ নিবন্ধিত জেলের কেউ চাল পাননি। চরফ্যাসন উপজেলার এওয়াজপুর, মাদরাজ ও হাজারিগঞ্জ ইউনিয়নের ২১ জেলের দেওয়া তথ্যমতে, তারা সবাই দুই মাসের চাল পেয়েছেন। সরকারিভাবে তাদের জন্য চার মাসের জন্য ১৬০ কেজি করে চাল বরাদ্দ হলেও তারা কেউ পূর্ণাঙ্গ বরাদ্দ পাননি। পুরো জেলায় কেউই ১৬০ কেজি চাল পাননি।
জেলেদের জন্য বরাদ্দ
জাটকা আহরণে বিরত থাকা জেলেদের জন্য মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় চলতি বছর চার মাসের জন্য চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। জেলায় ১ লাখ ৫৯ হাজার নিবন্ধিত জেলে থাকলেও ৮৯ হাজার ৪১০ পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৪ হাজার ৩০৫ টন চাল। প্রথমে মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ আসে জেলা প্রশাসকের কাছে। জেলা প্রশাসক বরাদ্দ দেন ইউএনওদের অনুকূলে। ইউএনওরা সুবিধাভোগীদের মধ্যে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুকূলে বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। জেলা প্রশাসক গত ৯ জানুয়ারি এ চাল বরাদ্দ দেন।
বিতরণে অনিয়ম
মানবিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ি মঞ্জুরীকৃত ভিজিএফ চাল বিতরণকালে মৎস্য অফিসের প্রতিনিধি এবং ট্যাগ অফিসারদের উপস্থিত থেকে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথা। ইউনিয়ন পরিষদ সুবিধাভোগী প্রত্যেকের কাছ থেকে মাস্টার রোলে টিপ বা স্বাক্ষর রাখবেন। প্রত্যেক সুবিধাভোগী মাস্টার রোলের চারটি ঘরে স্বাক্ষর করে চার মাসের চাল বুঝে নেবেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো চাল বিতরণ করছেন। মৎস্য অফিসের প্রতিনিধি বা ট্যাগ অফিসাররা বিতরণকালে উপস্থিত থাকেন না। তাই চেয়ারম্যানরা সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নেন। ইউনিয়ন পরিষদ গড়িমসি করে নিষেধাজ্ঞার শেষ দিকে এসে তড়িঘড়ি করে দুই মাসের চাল বিতরণ করেন। আর বাকি দুই মাসের চাল কোথায় যায়, সেই হিসাব নেওয়ার কেউ থাকে না।
জমা হয়নি মাস্টার রোল
চাল বিতরণের একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে ‘মাস্টার রোল’। এটা সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। সরকারের এ সুবিধা কোন কোন ব্যক্তি নিয়েছেন তাঁর নাম, পরিচয়, কার্ড নম্বর এসব মাস্টার রোলে উল্লেখ করা থাকে। চলতি বছরের চাল বিতরণ শেষ হয়েছে গত মে মাসে। চার মাস অতিক্রম হওয়ার পরও জেলার একটি ইউনিয়নও সংশ্লিষ্ট উপজেলায় মাস্টার রোল জমা দেননি বলে কর্তৃপক্ষ জানান।
এ প্রতিবেদক ভোলা সদর, চরফ্যাসন, তজুমদ্দিন, দৌলতখান ও লালমোহন উপজেলায় মাস্টার রোলের জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন। তবে কেউই দিতে পারেননি। চরফ্যাসনের ইউএনও নওরিন হক ইউনিয়ন থেকে মাস্টার রোল সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য একজন অফিস সহকারীকে দায়িত্ব দিলেও এক মাসে তিনি তা সংগ্রহ করতে পারেননি। লালমোহন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হাসান মিনার জানান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এখনও মাস্টার রোল অফিসে জমা দেননি।
তালিকা তৈরিতে অনিয়ম
জেলে তালিকায় অন্য পেশার লোকদের নাম অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রকৃত জেলেদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। সদর উপজেলা শিবপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জেলে তালিকা যাচাই করে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ৭০ জনের মধ্যে ৪৫ জনই অন্য পেশায় জড়িত। তালিকায় নাম রয়েছে বর্তমান মহিলা মেম্বারের স্বামী, সাবেক মেম্বারের খালাতো ও চাচাতো ভাই, কৃষক, অটোচালক, স’মিল শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, দোনকানদারসহ বিভিন্ন পেশাজীবী। শিবপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মেম্বার শিল্পী বেগমের স্বামী জসিম উদ্দিন ব্যবসা করেন। তাঁর নামেও জেলে কার্ড রয়েছে।
জেলে সমিতির বক্তব্য
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমিতি ভোলা সদর উপজেলার সভাপতি এরশাদ ফরাজি ও কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মাঝি জানান, জেলেরা সরকারি সহায়তা কখনোই পুরোপুরি পান না। সুবিধাভোগী তালিকা করতে ইউনিয়ন টাস্কফোর্সে মৎস্যজীবী সমিতির সদস্য রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এ সুযোগে অন্য পেশার লোকজনকে জেলে হিসাবে নিবন্ধন করছে।
জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের ভাষ্য
তজুমদ্দিনের চাঁদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল্যাহ কিরণ বলেন, তাঁর ইউনিয়নে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৭ হাজার ৩১০ জন। অনিবন্ধিতসহ জেলে প্রায় ১০ হাজার। খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন ৪ হাজার ৩১২ জন। তাদের সবাইকে তিনি চাল দিয়েছেন। এতে কোনো অনিয়ম হয়নি।
সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালের দাবি, বরাদ্দ কম পাওয়ায় সবার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন।তবে নীতিমালা অনুযায়ী নির্বাচিত জেলেরা পুরো চার মাসের সহায়তা পাবেন। সবার মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার বিষয়টিও অনিয়ম। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, চাল বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও জেলেদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না। বরাদ্দটা সরাসরি চেয়ারম্যানদের অনুকূলে দেওয়া হয়। তারা তালিকা করে ইচ্ছামতো বিতরণ করেন। দেখার দায়িত্ব থাকে ইউএনওদের। এখানে মৎস্য বিভাগের তেমন কিছু করার নেই।