USA

জেলে থেকেও কী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়া যায়

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নজিরবিহীন এক ঘটনা- সাবেক বা বর্তমান প্রেসিডেন্টদের মধ্যে প্রথমবারের মতো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেশিরভাগ বিশ্লেষক একমত যে, গত বৃহস্পতিবার ম্যানহাটনের আদালত ট্রাম্পকে যে ৩৪ অভিযোগে অভিযুক্ত করল তিনি হয়তো সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন- সেই প্রক্রিয়া হয়তো বিষয়টিকে টেনে নিয়ে যাবে নভেম্বরের নির্বাচনের পরেও, অনেক দূরে। এমনকি এই রায় নিশ্চিত হলেও হয়তো তার সম্ভাব্য সাজা হতে পারে জরিমানা কিংবা পর্যবেক্ষণে থাকা।

কিন্তু সবচেয়ে খারাপ যেটি হতে পারে– কারাদণ্ড- সেক্ষেত্রেও ট্রাম্প প্রার্থিতা চালিয়ে যেতে পারবেন।  

কীভাবে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী হোয়াইট হাউজের জন্য লড়তে পারেন

প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের জন্য যেসব আইনি নিয়মকানুন তা ১৭৮৯ সালের পর আর পরিবর্তন হয়নি। ওই বছর জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

 ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রফেসর ইওয়ান মর্গান বিবিসিকে বলেন, একটি যোগ্যতার কথা বলা আছে যে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে বা এর আওতাধীন ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করতে হবে। সেজন্য হইচই হয়েছিল যে ওবামা (সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা) সত্যিকার অর্থে আমেরিকার নাগরিক কি না। এবং তাদের বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর হতে হবে।

তিনি আরও বলেছেন, প্রার্থীকে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ১৪ বছর বাস করতে হবে। গৃহযুদ্ধের পর আরেকটি বিধিনিষেধ যোগ করা হয়। সেটি হলো যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জড়াবে।

যদিও তার বিশ্বাস এর কোনোটিই সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রয়োগের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের হোয়াইট হাউসের জন্য লড়াইয়ের বিষয়ে কোনো নিয়ম-কানুন বলা নেই। প্রফেসর মর্গান মনে করেন এর কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রা শুরুর ইতিহাস। 

প্রফেসর মর্গান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এবং সেই কারণে এমন সম্ভাবনা ছিল যে রাজতন্ত্র বিরোধী তৎপরতায় জড়িয়ে কেউ হয়তো জেল খাটতে পারেন— তখনও যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশ কলোনি- ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য তিনি অযোগ্য হয়ে পড়তে পারেন।

দেশটির প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের- যারা ১৭৮৭ সালে সংবিধান প্রণয়ন করেছেন– তারা মূলত ব্রিটিশদের দ্বারা বন্দি ছিলেন, বলছিলেন প্রফেসর মর্গান।

“বিপ্লব সফল না হলে তারা হয়তো রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হতেন এবং অপরাধী সাব্যস্ত হতেন।”

এ কারণেই সংবিধান প্রণেতারা এ বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করতে চাননি, যে নীতির সুযোগে এ পর্যন্ত তিনজন জেলে থেকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন। 

ইয়ুজিন ভি ডেবস

ইয়ুজিন ভি ডেবস ১৯১২ ও ১৯২০ সালে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়েছিলেন। তিনি ১৯২০ সালে ফেডারেল কারাগারে ছিলেন। যদিও ওই সময় তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী ছিলেন।

১৮৯৪ সালে তিনি প্রথম বন্দি হয়েছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তা হিসেবে। তিনি একটি ট্রেন কোম্পানির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মেইল ট্রেনে বাধা দেয়ার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিলো।

সেনাবাহিনী ধর্মঘট ভেঙ্গেছিল এবং ডেবসকে ছয় মাসের জন্য কারাগারে যান। এই অভিজ্ঞতা তার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

“বিশ শতকের শুরুতে তিনি সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হন। ১৯০৪, ১৯০৮, ১৯১২ ও ১৯২০ সালে দলের প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন,” বলছিলেন প্রফেসর মর্গান।

তিনি ১৯০০ সালে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির টিকিট নিয়েও নির্বাচন করেছিলেন। “১৯১২ সালে ডেমোক্র্যাট উড্রো উইলসন, রিপাবলিকান উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফ্ট, প্রগতিশীল প্রার্থী ও সাবেক রিপাবলিকান থিওডর রুজভেল্ট এবং ডেবস কৃতিত্ব দেখান।”

“তিনি প্রায় দশ লাখ ভোট পান, যা মোট ভোটের ছয় শতাংশ ছিল। আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ শতাংশ ভোট,” বলেন মি. মর্গান।

তিনি কোনো ইলেক্টরাল কলেজ ভোট জেতেননি, তবে ফ্লোরিডায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আমেরিকান সমাজতন্ত্রীদের জন্য বড় সংকট তৈরি করে বলে বলছেন প্রফেসর মর্গান।

“আপনি কি দেশপ্রেমের দিক থেকে সমর্থন করেন নাকি পুঁজিবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা করেন?ডেবস ছিলেন যুদ্ধের বিপক্ষে এবং আমেরিকানদের এতে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করেন,” বলছিলেন প্রফেসর মর্গান। 

১৯১৮ সালে তখন যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। ডেবস ওহাইও এর ক্যান্টনে ভাষণ দেন। এরপর তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয় এবং ১৯১৯ সালের এপ্রিলে তাকে জেলে দেয়া হয়। পরের বছর ভোটে তার প্রার্থী হবার কথা এবং সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ আমেরিকা তাকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়। 

১৯১২ সালের চেয়ে এবার বেশি ভাট পান। কিন্তু তা ছিল মোট ভোটের মাত্র তিন শতাংশ। আমেরিকান নারীদের ততদিনে ভোটাধিকার পাওয়া হয়েছে। তখন আটলান্টা কারাগারের অবস্থা এখনকার মতো ছিলো না এবং বন্দী জীবনের মূল্য ডেবসকে ভালোভাবেই দিতে হয়।

প্রায় তিন বছর জেল খেটে তিনি বের হন কিন্তু তার স্বাস্থ্য আর পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি। এবং তিনি ১৯২৬ সালে মারা যান।

তার পরে সোশ্যালিস্ট পার্টির কেউ আর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারেনি। 

লিন্ডন লারুশ

লারুশ একটি রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা চালিয়েছিলেন জেলে থেকে।

“তিনি কখনো ডেমোক্র্যাট হিসেবে আবার কখনো তৃতীয় কোনো দলের প্রার্থী এবং তার নাম ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনের ব্যালটে ছিল। এটা ছিল তার শখ,” বলছিলেন প্রফেসর মর্গান।

তিনি চল্লিশ এর দশকে বাম ঘরানায় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু সত্তরের দশকে তিনি হন ‘ডানপন্থী’।

প্রফেসর মর্গানের মতে তিনি ছিলেন একজন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ পাগল মানুষ। তবুও জনপ্রিয় কিছু ইস্যুতে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন তৈরি করেন। যেমন কর কমানো কিংবা রাষ্ট্র যেন নাগরিকদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি না করে।

লারুশের সমর্থিত প্রার্থীরা বিস্ময়করভাবে ১৯৮৬ সালে ডেমোক্র্যাট মনোনয়ন জেতেন ইলিনয় রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিপুল তহবিল সংগ্রহ করতে সক্ষম হন তারা।

তিনি প্রতারণার দায়ে ১৯৮৯ সালে জেলে যান ও পনের বছরের কারাদণ্ড হয় তার।

“এর মধ্যে ১৯৯২ সালের নির্বাচন এলে তিনি তাতে অংশ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। ২৭ হাজারের মতো ভোট পেয়েছিলেন, যা মোট ভোটের শূন্য দশমিক এক শতাংশ।”

দণ্ড কমিয়ে দিলে ১৯৯৪ সালে তিনি মুক্তি পান। পরে ১৯৯৬, ২০০০, ২০০৪ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেন।

জোসেফ স্মিথ

বন্দি অবস্থায় ১৮৪৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রচারণা চালাবার সময় গুলিতে নিহত হন মরমনের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ স্মিথ। তিনি ‘মরমনিজম’- ক্যাথোলিক, প্রটেস্টান্ট বা অর্থোডক্স চার্চের চেয়ে ভিন্ন ধরার খ্রিষ্ট ধর্মীয় একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

প্রফেসর মর্গান বলছেন, “এটি খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। বরং মৌলিক আমেরিকান মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এটিকে একটি হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছিলো। বহুগামিতাকে ভয়ানক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং স্মিথের বিশটির মতো স্ত্রী ছিল।”

ম্যাসাচুসেটস থেকে উঠে আসা স্মিথ তার অনুসারীদের জন্য ইলিনয়ের পশ্চিমে একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজছিলেন। ১৮৪০ এর দিকে মরমনরা সেখানেই তাদের শহর গড়ে তোলে মিসিসিপি নদীর তীরে, যেখানে তারা বসবাস ও শান্তির জন্য প্রার্থনার আশা করেছিলো।

স্মিথ মেয়র পদে জিতেছিলেন এবং মরমন মিলিশিয়া তৈরি করেছিলেন।

“কিন্তু সমস্যা হলো মরমনিজমে বিশ্বাসীদের মধ্যেই তাকে ঘিরে বিভাজন তৈরি হয়। তার বহুগামি কর্মকাণ্ড অন্য মরমনদের মধ্যে শত্রুতা তৈরি করে বিশেষ করে যাদের স্ত্রীদের তিনি ভাগিয়ে এনেছিলেন।”

স্মিথ তার মিলিশিয়াদের স্মিথ-বিরোধী পত্রিকা ছাপাখানা গুড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটিই শেষ পর্যন্ত তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে।

তিনি ১৮৪৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন রিফর্ম পার্টির প্রার্থী হিসেবে। মরমন ভিত্তিক দলটি কয়েকটি বিষয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলো। এগুলো হলো- ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, বহুগামিতাকে উৎসাহিত করা এবং স্মিথের নিজস্ব ভাবনা- প্রতিটি পুরুষ আসলে একজন ঈশ্বর।

কারাগারের বাইরে উচ্ছৃঙ্খল লোকজন সমবেত হয় এবং তিনি ও আরও কয়েকজন বন্দি যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই ভবনের মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। 

রিফর্ম পার্টি ১৮৪৪ সালের নির্বাচনের জন্য বিকল্প আর প্রার্থী বেছে নেয়নি। সুতরাং তিনজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কারাগারে থেকে সর্বোচ্চ পদের জন্য লড়াই করেছিলেন। চতুর্থ একজন হতে পারেন যদি জোসেফ মালডোনাডো-প্যাসাজ নভেম্বরের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান।

২০২০ সালের নেটফ্লিক্স ডকুমেন্টারি স্টার ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হবার ঘোষণা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি এখন প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা সম্পর্কিত বিভিন্ন অভিযোগে বিশ বছরের জেল খাটছেন।

তবে ট্রাম্পের অবস্থান একই ধরনের নয়। বরং জেলে গেলেও তিনি লড়বেন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী হিসেবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button