International

জেলে থেকে যেভাবে পাকিস্তানকে প্রভাবিত করছেন ইমরান খান

  • প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে সেনাবাহিনীর অনুগ্রহে থাকতে হবে
  • ২০২২ সালে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন খান
  • তিনি কারাগারে এক মিনিটও সময় নষ্ট করছেন না: বোন আলিমা খানম

প্রায় এক বছর হতে চলল পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কারাগারে আছেন। যদিও খুব কম ক্ষেত্রেই আপনি সেটা বুঝতে পারবেন। কারণ এখনও পাকিস্তানের বিরোধী রাজনীতির প্রভাবশালী শক্তি খান। কাগজপত্রে ও আদালতে তার নাম আসছে নিয়মিত, আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার সমর্থকরা ‘অদম্য’।

জনসমক্ষে আসতে না পারলেও এই সাবেক ক্রিকেট তারকার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে আসা অল্প কিছু মানুষ বহির্বিশ্বের কাছে তার বার্তা পৌঁছানোর একমাত্র দূত হয়ে উঠেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন খানের আইনজীবীরা ও পরিবার। ৩৬৫ দিন ধরে কারাগারে থাকা সত্ত্বেও যে খান মাথা নত করেননি, সেই বার্তা পাঠাতেই আগ্রহী তার আইনজীবী ও তার পরিবারের সদস্যরা।

খানের বোন আলিমা খানম বলেন, ‘ওর মধ্যে একটা সদম্ভ ব্যাপার আছে। ওর কোনও চাহিদা নেই, কোনও চাওয়া-পাওয়া নেই। আছে শুধুমাত্র একটা উদ্দেশ্য।’

যারা দেখা করতে যান, তাদের মতে এই সাবেক ক্রিকেট তারকার দিন কাটে এক্সারসাইজ বাইকে কসরত করে, বই পড়ে এবং ভাবনা চিন্তা করে। উঠানে ঘুরে বেড়ানোর জন্য তার হাতে দিনে এক ঘণ্টার মতো সময় থাকে। পরিবার কত তাড়াতাড়ি তাকে নতুন বই সরবরাহ করতে পারে তা নিয়ে অবশ্য মাঝে মাঝে মতবিরোধও দেখা যায়। কিন্তু বাস্তব বিষয় হলো, খান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবি এখনও কারাগারে আটক আছেন। তাদের মুক্তি পাওয়ার কোনও লক্ষণ খুব শিগগির দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, এটা খুব একটা আশ্চর্য হওয়ার বিষয় নয়।

আলিমা খানম বলেন, ‘কারাগারে এক মিনিটও সময় নষ্ট করছেন না বলে জানিয়েছেন উনি। এটা তার কাছে আরও জ্ঞান অর্জন করার একটা সুযোগ।’

ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টার থিংক ট্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘তার জেল থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়টা সহজ হয়, ইমরান তেমন কিছু একটা করবেন বলে কোনও প্রত্যাশা ছিল না।’

কুগেলম্যান জানিয়েছেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী হলো পর্দার আড়ালে থাকা আসল শক্তিশালী খেলোয়াড়। তার কথায়, ‘তারা যখন সিদ্ধান্ত নেয় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে বন্দি রাখার, তখন তারা এত চট করে শান্ত হয় না। খানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে।’

গত এক দশকে খানের জীবনের অনেক উত্থান-পতনের মূলে ছিল এই সেনাবাহিনী। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, প্রথম দিকে সামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে খানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই তাকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু সেই ছবি একেবারে বদলে গেছে। গত বছরে সেই সম্পর্ক এসে তলানিতে ঠেকে।

২০২২ সালে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর গত বছরের ৯ই মে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন তার সমর্থকরা। এর মধ্যে কিছু বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে এবং একাধিক সামরিক ভবনে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ। এই তালিকায় লাহোরের সবচেয়ে সিনিয়র সেনা কর্মকর্তার সরকারি বাসভবনও ছিল, যেখানে লুট চালানো হয় এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর পাকিস্তানের মিডিয়া সংস্থাগুলোকে খানের ছবি দেখানো, তার নাম নেওয়া বা কণ্ঠস্বর বাজানো বন্ধ করার কথা জানানো হয়। সূত্র মারফত বিবিসি এই বিষয়ে জানতে পারে। তবে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল বটে তবে তা মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে সমস্ত উপহার পেয়েছিলেন, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে না পারার অভিযোগে তাকে গত বছরের ৫ আগস্ট আবার গ্রেফতার করা হয় এবং এটা কিন্তু শুধুমাত্র সূত্রপাত ছিল। নির্বাচনের আগে তার বিরুদ্ধে মামলা বাড়তে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে অর্থাৎ ভোটের মাত্র কয়েকদিন আগে, ৭১ বছর বয়সী এই নেতাকে তিন মেয়াদের কারাদণ্ড দণ্ডিত করা হয়। এর মধ্যে সর্বশেষ সাজার মেয়াদ ছিল ১৪ বছরের।

পাকিস্তানে নির্বাচনের সময় খানের দল পিটিআইয়ের প্রার্থীদের অনেকেই হয় কারাগারে ছিলেন অথবা আত্মগোপন করেছিলেন। ওই দলের ক্রিকেট ব্যাটের প্রতীক চিহ্নও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ৫৮% স্বাক্ষরতার দেশ পাকিস্তানে এই দলের প্রতীক সুপরিচিত ছিল। খানের আইনজীবী ও নির্বাচনে প্রার্থী সালমান আক্রম রাজা বলেন, ‘তা সত্ত্বেও আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘একেবারে কোণঠাসা পরিস্থিতি ছিল। অনেকেই নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারেননি। ক্রিকেট ব্যাটের প্রতীক হারিয়ে যাওয়াটা ছিল আঘাতের মতো।’ যেহেতু পিটিআইয়ের সব প্রার্থীই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, তাই দলের অন্দরমহলেও তেমন আশার আলো দেখা যায়নি।

তবুও খানের সমর্থিত প্রার্থীরা অন্যদের তুলনায় বেশি আসন জিতেছেন এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের জোট গঠন করতে বাধ্য করেছে। কারচুপির অভিযোগ তুলে পিটিআই আদালতের দ্বারস্থ হয়। সমর্থকরা কিন্তু ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে কারাগারের ভিতরে থেকেও ইমরান খানের শক্তিশালী উপস্থিতির বার্তা দেয় এই নির্বাচন।

আলিমা খানম বলেন, ‘একটা পরিবর্তন এসেছে এবং সেটা প্রকাশ পেয়েছে ৮ ফেব্রুয়ারি। পরিবর্তন আসছে এবং তার আভাস রয়েছে বাতাসে।’ আবার কেউ কেউ মনে করেন, এই নির্বাচনী ফলাফলে স্থিতাবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি।

কুগেলম্যান বলেন, ‘আমরা সত্যিই সেখানে রয়েছি, যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা অতীতের নজির প্রত্যাশা করতে পারি। পিটিআই সরকার গঠন করেনি, তাদের নেতা এখনও কারাগারে এবং ক্ষমতায় থাকা জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে সামরিক বাহিনী সমর্থিত দলগুলো।’ কিন্তু সাম্প্রতিককালে খান এবং তার সমর্থকদের জন্য পরিস্থিতি একটু হলেও বদলেছে। নির্বাচনের ঠিক আগে দেওয়া তিনটি সাজার সবকটাই বাতিল হয়ে গেছে।

জাতিসংঘের একটা প্যানেল খানকে আটক করার বিষয়কে ‘স্বেচ্ছাচার’ বলে ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে পিটিআই একটি সরকারি দল। তাদের ‘সংরক্ষিত আসন’ পাওয়া উচিত। কিন্তু এর কোনওটাই বাস্তবে হয়নি। খান এখনও কারাগারেই রয়েছেন। তার নামে নতুন মামলা হয়েছে। সংরক্ষিত আসন পিটিআইকে এখনও বরাদ্দ করা হয়নি।

খানের স্ত্রী বুশরা বিবিও কারাগারে রয়েছেন। তার নামেও নতুন অভিযোগ উঠেছে। তবে খানের সঙ্গে তার বিয়ে অবৈধ বলে যে মামলা দায়ের করা হয়েছিল তা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন এই দম্পতি। এরই মধ্যে পাকিস্তানের সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছে তারা খান ও তার দলকে জনগণের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করে। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও সরকার চলতি মাসের শুরুতেই ঘোষণা করেছিল তারা পিটিআইকে নিষিদ্ধ করতে চায়। সামরিক বাহিনী কিন্তু তাদের মত পরিবর্তনের কোনও ইঙ্গিত দেয়নি।

চলতি বছরের ৯ মে সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ শাখা একটা বিবৃতিতে জানিয়েছিল, ‘পরিকল্পনাকারী, সেখানে যারা মদত দেয় এবং জল্লাদদের’ সাথে কোনও আপস করা হবে না এবং তাদের ‘দেশের আইনকে ফাঁকি দেওয়ার’ অনুমতিও দেওয়া হবে না। বিশ্লেষকদের মধ্যে অধিকাংশই মনে করেন যে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ‘সম্পর্কই’ শেষ পর্যন্ত কারাগার থেকে খানকে বাঁচাতে পারে।

খানের আইনজীবী রাজা বলেন, ‘আমরা এমন একটা উপায় খুঁজে বের করছে চাইছি যা সবার পক্ষে আর একইসঙ্গে প্রশাসনও কাজ করতে পারে।’

এদিকে খান কিন্তু কারাগারে থেকেই নিজের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। আলিমা খানম সম্প্রতি জানিয়েছেন, খান সেনাবাহিনীকে বলেছেন, ‘নিরপেক্ষ থাকতে… যাতে দেশ চলতে পারে’। সেনাবাহিনীকে ‘পাকিস্তানের মেরুদণ্ড’ বলেও মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

এই বিষয়টি অবশ্য ‘শান্তি সমঝোতা’ হিসেবে দেখেছেন অনেকে। কারণ এর আগে সেনাবাহিনী যখন নিজেদের ‘নিরপেক্ষ’ বলে দাবি করেছিল, সে সময় এই বিষয়ে উপহাস করেছিলেন খান। বলেছিলেন, ‘শুধুমাত্র একটা জন্তুই নিরপেক্ষ হতে পারে।’

সাম্প্রতিককালে খান যে আগাম নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন সেটাকে অনেকেই সামরিক বাহিনীর কাছে রাখা ‘শর্তগুলোর’ মধ্যে একটা বলে মনে করেন। কুগেলম্যান বলেন, ‘আমি মনে করি না যে এটি খুব বাস্তবসম্মত’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খান কিছুটা নমনীয় হতে পারেন। পাকিস্তানি রাজনীতির একটা বাস্তবতা হলো, যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান, তবে আপনাকে সেনাবাহিনীর অনুগ্রহে থাকতে হবে। অন্তত একেবারে বিপক্ষে চলে গেলে হবে না।’ পাকিস্তানের অচলবস্থা অবশ্য এখনও অব্যাহত রয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button