Bangladesh

জ্বলছে না চুলা, চলছে না কলকারখানা

রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় একটি ছোট্ট হোটেল চালান নুরু মিয়া। লাইনের গ্যাসের স্বল্প চাপের কারণে মাঝে মাঝে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। দিনে চাপ থাকেই না। এক সপ্তাহ ধরে গ্যাসের চাপ এতই কম যে, দিনরাতে কোনো সময়ই রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না।
একই অবস্থা শান্তিনগরের বাশারুল হকের বাসায়। গত ১৫ দিন গ্যাস সংকটে রান্নায় ভোগান্তি হচ্ছে পরিবারটির। সকাল ৯টার পর গ্যাস একদম থাকে না লাইনে। দুপুরে খানিকটা এসে সন্ধ্যায় আবার চাপ কমে যায়। ফের গ্যাস আসতে আসতে মধ্যরাত। ফলে রাত জেগে রান্না করে দিনভর খেতে হচ্ছে বাশারুলদের।

ভোগান্তি সিএনজি স্টেশনগুলোতেও। চাপ কম থাকায় দীর্ঘ সময় ব্যয় হচ্ছে গাড়িতে গ্যাস নিতে। দুর্ভোগ চলছে শিল্পকারখানাগুলোতেও। গ্যাস সংকটে দিনের একটা বড় সময় উৎপাদন বন্ধ থাকছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে শীতকালে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় গ্যাস সংকট দেখা দিত। এখন সংকট এত বেড়েছে যে, শীত আসার আগেই ভোগান্তিতে পড়েছে ঢাকাবাসী।

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলছে, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হওয়ায় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি গ্যাস দেওয়ায় আবাসিকে এবং শিল্পে সংকট দেখা দিয়েছে। সূত্র জানায়, ঘোড়াশালের ইউরিয়া সার কারখানায় গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় রাজধানীতে সরবরাহ কমেছে। গত ‌১৭ সেপ্টেম্বর ঘোড়াশাল সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা হয় ৪৩ কোটি ঘনফুট। এক মাস পর ১৭ অক্টোবর তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৬২ কোটি ঘনফুট।

বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪২০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলা বুধবার সরবরাহ করেছে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা গ্যাস (এলএনজি) ৭০ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বুধবার গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ১০৭ কোটি ঘনফুট।

দিনভর ভোগান্তি

সাংবাদিক আমীন আল রশীদ গত মঙ্গলবার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‌‌মাসে বিল ১০৮০ টাকা। অথচ সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে গ্যাস চলে যায়। সারাদিনের রান্না করে দেবে কে? ইলেকট্রিক চুলায় করলে প্রতি মাসে গ্যাসের বিল কেন দেব? এগুলো তো সিম্পলি নৈরাজ্য।‌’ সেখানে মানিকগঞ্জ জেলা সদরের বাসিন্দা সাইফুদ্দিন আহমেদ লেখেন, ‘আমরা এক যুগ ধরে ২৪ ঘণ্টায় এক ঘণ্টার বেশি পাই না। তাও রাত ১২টার পর। কেবল দুই ঈদের বন্ধে গ্যাস পাই।’ বিশ্বব্যাংকের দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক পরামর্শক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী লিখেছেন, ‘গৃহকর্মী সকালে মাছ, মাংস, সবজি, ডাল রান্না করে দিয়ে যায়। বিকেল ৩টার আগে ভাত রান্না করা হয় না। ৯টা থেকে গ্যাস চলে যায়। ২টার আগে কখনও আসে না।’

গত বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মুগদা ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাড়িতেই পাইপলাইনের গ্যাসের চুলা বন্ধ। রান্না হচ্ছে মাটির চুলা অথবা সিলিন্ডার গ্যাসে। অনেক বাসায় ইলেকট্রিক চুলাতেও রান্না করতে দেখা গেছে। অধিকাংশ হোটেলে ব্যবহার করা হচ্ছে এলপি গ্যাস। শ্যামপুর অটবির মোড় এলাকার একটি তিনতলা বাসার নিচতলায় থাকেন মাসুম-লাবণী দম্পতি। দু’জনই পোশাক কারখানায় কাজ করেন। সকাল ৭টাতেই বাসা থেকে বের হতে হয়। তাই বাসার গণচুলায় ভোরে উঠেই রান্নার কাজ সারেন লাবণী। কিন্তু গত কয়েক দিন থেকে ভোরে উঠেও কাজ হচ্ছে না। ভোর ৫টার মধ্যেই গ্যাস চলে যায়। আসে রাত ১১টার পর। কারখানা থেকে ফিরে এত রাতে রান্না করে সকালে ওঠা কষ্টকর। তাই ঘরের পাশে একটি মাটির চুলা বসিয়ে তাতেই এখন রান্নার কাজ সারছেন। তিনি জানান, মাসে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকার লাকড়ি লাগছে। আবার চুলার জন্য প্রতি মাসে বাড়িওয়ালাকে গ্যাসের বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে। দক্ষিণ বনশ্রীর কে-ব্লকের সাত নম্বর রোডের বাসিন্দা রাকিব হোসেন জানান, গ্যাস সংযোগ থাকার পরও দেড় বছর ধরে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করছেন। মাসে দেড় সিলিন্ডার গ্যাসে তাদের চার সদস্যের পরিবারের রান্নার কাজ হয়ে যায়। গ্যাস বিল দেওয়ার পরও মাসে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে সিলিন্ডারের জন্য। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার বাসিন্দা রাজিউল কবির বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে গত কয়েক মাসে চারজন ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গ্রাহক ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না। কিন্তু প্রতি মাসে বিল দিতে হচ্ছে। প্রিপেইড মিটার থাকলে বাড়তি বিল দিতে হতো না কিন্তু সেই মিটার বসাতে অনীহা তিতাসের। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। তারা দ্রুত সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। সিএনজি স্টেশনে দীর্ঘ লাইন অন্য খাতে সরবরাহ বাড়াতে সিএনজি পাম্পগুলো প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ৫ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। গাড়িতে গ্যাস নিতে তাই দিনভর স্টেশনগুলোতে ভিড় থাকে। গ্যাস নিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কিছুদিন ধরে চাপ কমে যাওয়ায় ভোগান্তি আরও বেড়েছে রাজধানীর সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন না চালকরা। বুধবার দুপুরে মালিবাগে একটি সিএনজি স্টেশনে অটোরিকশাচালক রবিউল বলেন, ৩০০ টাকার গ্যাস নিলে সারাদিন চলে। কয়েক দিন থেকে ১৫০ টাকার বেশি গ্যাস নেওয়া যাচ্ছে না। যে পাম্পেই যাই বলে চাপ কম। দিনে দুই-তিনবার গ্যাসের জন্য লাইন দিতে হচ্ছে। একবার লাইন ধরে গ্যাস নিতে লাগছে দুই-তিন ঘণ্টা। যাত্রাবাড়ীর একটি সিএনজি স্টেশনের ব্যবস্থাপক মকবুল হোসেন বলেন, চাপ থাকার কথা ১০-১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে গ্যাস চাপের ইউনিট)। অথচ পাওয়া যাচ্ছে ৩-৫ পিএসআই। সংকটে শিল্পকারখানা

ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, সাভার, ময়মনসিংহ এলাকার কারখানাগুলো গ্যাস সংকটে ধুঁকছে। কারখানার মালিকরা বলছেন, যেসব কারখানা চালাতে গ্যাসের চাপ প্রয়োজন ১৫ পিএসআই সেখানে মিলছে ২-৩ পিএসআই। তাদের প্রশ্ন, এ অবস্থায় কারখানা চলবে কেমন করে? দিনের একটা বড় অংশ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তবে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে ঠিকই। এভাবে লোকসান দিতে হলে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d