Bangladesh

জ্বালানি তেলের দাম কিঞ্চিৎ কমল

অবশেষে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে সরকার। নতুন দর অনুযায়ী ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৭৫ পয়সা, অকটেনে ৪ এবং পেট্রোলে ৩ টাকা কমানো হয়েছে।

দেশে প্রথমবারের মতো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া চালুর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমলে দেশে কমবে আবার বাড়লে দেশের বাজারেও বাড়বে। তবে ডিজেলের দাম কমলে বা বাড়লে পরিবহন ভাড়া কী হবে তা নিয়ে এখনো সরকারের কোনো নির্দেশনা পায়নি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ।

দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। এটি সাধারণত সেচে ও পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। ফলে দাম কমার প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে খুব বেশি পড়বে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বরং পরিবহন ব্যবসায়ীদের লাভ বাড়বে। গতকাল বৃহস্পতিবার জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আজ শুক্রবার থেকে নতুন দর কার্যকর হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে সরকার গত ২৯ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি ঘোষণা করে। এ পদ্ধতি অনুসারে প্রথমবারের মতো দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হলো।

প্রজ্ঞাপন অনুসারে, প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের বর্তমান বিক্রয়মূল্য ১০৯ থেকে কমিয়ে ১০৮ টাকা ২৫ পয়সা করা হয়েছে। এদিকে প্রতি লিটার অকটেনের দাম ১৩০ থেকে কমিয়ে ১২৬ ও পেট্রোল ১২৫ থেকে কমিয়ে ১২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ^বাজারের দাম অনুসারে দেশে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমা উচিত ছিল। সরকার নামমাত্র দাম কমিয়েছে। তারা আরও বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমার প্রভাব পরিবহনের ভাড়ার ওপর পড়া উচিত।

জ্বালানি বিভাগ বলছে, দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় বর্তমানে ডিজেল লিটারপ্রতি ১৩৩ টাকা ৫৭ পয়সা (১ রুপি=১.৪৪ টাকা) এবং পেট্রোল ১৫২ টাকা ৬৮ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে, যা বাংলাদেশ থেকে যথাক্রমে প্রায় ২৪ টাকা ৫৭ পয়সা ও ২৭ টাকা ৬৮ পয়সা বেশি।

বিপিসির লোকসান হচ্ছে এমন যুক্তিতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট দেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ থেকে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়। লিটারপ্রতি পেট্রোলের দাম ৮৬ থেকে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়। অকটেনের দাম ৮৯ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে করা ১৩৫ টাকা। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট এ চার ধরনের জ্বালানির দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা করে কমানো হয়। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে মাত্র ৩-৪ শতাংশ কমানো হয়েছিল। আর এবার মাত্র ০.৭ থেকে ৩ শতাংশ দাম কমানো হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিমের মতে, সরকার নামমাত্র দাম কমিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান তেলের যা দাম সে অনুসারে দাম আরও কমা উচিত ছিল। কী পদ্ধতিতে হিসাব করেছে তা স্পষ্ট নয়। বিপিসির আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, তেলের দাম কমেছে কিন্তু পরিবহন ভাড়া না কমলে এর সুফল তো জনগণ পাবে না।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমেছে এটা স্বস্তির বিষয়। তবে যতটুকু দাম কমেছে তা খুবই সামান্য। ২০২২ সালে তেলের দাম বাড়িয়ে কৃষি, পরিবহন ও অন্যান্য খাতে বড় ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এবার দাম এত অল্প কমানো হয়েছে যে, খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, গতবার ডিজেলের দাম বাড়ানোর ফলে কৃষকের বিঘাপ্রতি ব্যয় বেড়েছিল ২ হাজার টাকা। তার মতে, দাম কমাটা একটা মানসিক স্বস্তি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, দাম কমানোর প্রক্রিয়াটি আরও ভোক্তাবান্ধব হওয়া উচিত। বর্তমানে বিশ^বাজারে যা দাম তাতে লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম হওয়া উচিত ১০০ টাকার মতো। তিনি পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর প্রত্যাহারের দাবি জানান।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, দাম কমানোর লাভ মূলত পাবে ধনী ব্যক্তিরা। ডিজেলের সামান্য দাম কমায় পরিবহন ভাড়া কমবে না, মূলত পরিবহন ব্যবসায়ীরা লাভ করবে।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ডিজেলের দাম ৭৫ পয়সা কমার কোনো প্রভাব পরিবহন ভাড়ার ওপর পড়বে না।

বিপিসির লাভ : বিশ^বাজারে তেলের দাম কম থাকায় লাভ করছে বিপিসি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিসি নিট মুনাফা করেছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে ২০০ কোটি টাকা। সে সময় সরকারি কোষাগারে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, লভ্যাংশ, আয়করসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে বিপিসি। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত অর্থ হিসেবে বিপিসির কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে বিপিসি।

এর আগে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত কর-পরবর্তী বিপিসির নিট মুনাফা হয়েছে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। ওই সময়ে সরকারকে লাভ দিয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিপিসির উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে দুই দফায় ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। আর জ্বালানি তেলের শুল্ক-কর থেকে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। টানা সাত বছর মুনাফা করার পর শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা লোকসান করে সংস্থাটি। তখন অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) ১৪০ ডলার আর ডিজেলের দাম ১৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ধাপে ধাপে দাম কমতে থাকে।

বৃহস্পতিবার বিশ্ববাজারে মারবান ক্রুডের (অপরিশধিত) দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৩.০৪ ডলার। ডিজেলের দাম বর্তমানে প্রতি ব্যারল ৯৫ ডলার।

দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় এক কোটি টন। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ৬৫-৭০ লাখ টন আমদানি করে। বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ২০-২৫ লাখ টন আমদানি করে। আর দেশের পরিশোধনাগার থেকে কিছু তেল পাওয়া যায়।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রতি মাসে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। অনেকটা এ প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেলের দামও নির্ধারণ করা হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button