Trending

জ্বালানি তেল আমদানিতে ছয় মাসে প্রিমিয়াম খাতে বিপিসির সাশ্রয় হবে ৭৬০ কোটি টাকা

২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই

জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম খাতে ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৭৬০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি)। 

টেন্ডার শর্ত শিথিলকরণ এবং ব্যাপক দরকষাকষির মাধ্যমে সরবরাহকারী পরিবহন খরচ কমানোর ফলে এই সাশ্রয় হবে।

এর প্রভাবে গ্রাহক পর্যায়ে জ্বালানি তেলের দাম না কমলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে বর্ধিত ব্যয়ের বোঝা থেকে রেহাই দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন বিপিসি কর্মকর্তারা।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিপিসির তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে মোট ২৫.৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে কর্পোরেশন। 

এর মধ্যে প্রিমিয়াম দরকষাকষির মাধ্যমে প্রায় ১৪ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনা  হবে। 

সংশোধিত প্রিমিয়ামের ফলে গত ছয় মাসে কেনা বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলে ইউনিটপ্রতি নূন্যতম ২ ডলার থেকে ৩.৯৮ ডলার পর্যন্ত সাশ্রয় হবে। 

সিঙ্গাপুরভিত্তিক তেল পণ্যের জন্য প্ল্যাটস কর্তৃক প্রকাশিত মূল্য নির্ধারণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল কেনে। লোডিংয়ের দিন, দুই দিন আগের ও দুই দিন পরের—এই পাঁচ দিনের গড় দাম হিসাব করে ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এরপর এই গড়ের সাথে একটি প্রিমিয়াম যোগ করা হয়।

বিপিসি কর্মকর্তারা জানান, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের কাছে জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য ওই প্রতিষ্ঠান যে সার্ভিস চার্জ দেয়, তা-ই প্রিমিয়াম। এসব চার্জের মধ্যে আছে শিপিং খরচ, বিমা খরচ, পরিচালন ব্যয় ও প্রশাসনিক খরচ। প্রিমিয়াম ছয় মাসের জন্য নির্ধারিত হয়।

জ্বালানি তেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৫-৭০ শতাংশ আমদানি হয় ডিজেল। এ খাতে ব্যারেলপ্রতি প্রিমিয়াম হার ৮.৭৫ ডলার থেকে কমিয়ে ৫.১১ ডলার নির্ধারণ হয়েছে। 

অন্যান্য পরিশোধিত জ্বালানিতেও একইভাবে প্রিমিয়াম কমেছে। যেমন, জেট এ-১ বিমান জ্বালানির প্রিমিয়াম ব্যারেলপ্রতি ১০.৮৮ ডলার থেকে কমিয়ে ৭.৩২ ডলার করা হয়েছে, অকটেনের প্রিমিয়াম ব্যারেলপ্রতি ৯.৮৮ ডলার থেকে কমিয়ে ৫.৯৩ ডলার করা হয়েছে।

একইভাবে এইচএসএফও-র (ফার্নেস অয়েল) প্রিমিয়াম টনপ্রতি ৪৬.৭০ ডলার থেকে কমিয়ে ৪৪.৬৮ ডলার করা হয়েছে, আর মেরিন ফুয়েলের প্রিমিয়াম টনপ্রতি ৭৬.৮৮ ডলার থেকে কমিয়ে ৭২.৯০ ডলার করা হয়েছে।

গত মাসের শুরুর দিকে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত আলোচনার সময় এই হ্রাসকৃত দামে পরিশোধিত জ্বালানি ক্রয় চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল, বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান, জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশনস অ্যান্ড কমার্শিয়াল) মনি লাল দাস এবং ডেপুটি ম্যানেজার শ্যামল পাল আলোচনায় অংশ নেন।

ওমানের ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেড, মালয়েশিয়ার পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি লিমিটেড, সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, থাইল্যান্ডের পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, ইন্দোনেশিয়ার পিটি বুমি সিয়াক পুসাকো জাপিনসহ বেশ কয়েকটি সরবরাহকারীর কাছ থেকে জ্বালানি তেল কেনা হবে।

প্রিমিয়াম ও ক্রয়ে সাশ্রয়

আন্তর্জাতিক দরপত্র ও সরাসরি সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) চুক্তির ভিত্তিতে জ্বালানি তেল ক্রয়ে মোট ৭৬০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। 

আগামী ছয় মাসে জিটুজি প্রক্রিয়ায় প্রিমিয়াম খাতে ব্যয় সাশ্রয় হবে প্রায় ৩৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রিমিয়াম খাতেও এ সময়ে প্রায় ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। 

উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয়ে ডিজেলের প্রিমিয়াম হার ব্যারেলপ্রতি ৮.৮৩ ডলার ও ৮.৭৪ ডলার থেকে কমে যথাক্রমে ৫.২৬ ডলার (প্যাকেজ-এ) ও ৫.১৪ ডলারে (প্যাজেক-বি) নেমে এসেছে। এতে সার্বিকভাবে বড় অঙ্কের সাশ্রয় হয়েছে।

বাংলাদেশের মোট বার্ষিক জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭০-৭৫ লাখ টন। এর মধ্যে জিটুজি পদ্ধতিতে পরিশোধিত তেল কেনা হয় ২০-২৫ লাখ টন এবং আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে কেনা হয় সমপরিমাণ। 

এছাড়া সৌদি আরব ও আরব আমিরাত থেকে ক্রুড তেল কেনা হয় ১৩-১৫ লাখ টন। পরে তা ইস্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে পরিশোধন করা হয়। বাকি চাহিদা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মেটানো হয়।

গত কয়েক বছরে প্রিমিয়াম হার ব্যাপক বেড়ে গেছে। ২০২২ সালের আগে ইউনিটপ্রতি প্রিমিয়াম ছিল ৩ ডলারের কম। পরে ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য ভূরাজনৈতিক কারণে তা বাড়তে বাড়তে ২০২৩ সালে ১৩ ডলারের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকে। 

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি সরকারের উচ্চমহলের পছন্দমতো সরবরাহকারী সুযোগ দেওয়ার কারণে প্রিমিয়াম হার নিয়ে দরকষাকষির সুযোগ কম ছিল বলেও অভিযোগ ছিল। 

দরকষাকষিতে সাফল্য ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান সাম্প্রতিক ব্যয় সাশ্রয় কীভাবে সম্ভব হলো, তা জানাতে গিয়ে টিবিএসকে বলেন, ‘এবারের আন্তর্জাতিক দরপত্র খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ ছিল। কিছু শর্ত শিথিল করা হয়েছে। যেমন, যাদের (সরবরাহকারী) রিফাইনারি নেই, তারা সরবরাহ করতে পারবে না—আমরা সেটা তুলে দিয়েছি, সহজ করে দিয়েছি। ভালো ট্রেডার হলে, রিফাইনারি না থাকলেও সরবরাহ করতে পারবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আগের দরকষাকষির সময় অনেক বকেয়া থাকত। এ কারণে তারা বকেয়া নিয়ে কথা বলত। আর এগুলোও তারা ব্যয় হিসেব করত। এবার বকেয়া না থাকায় শক্তভাবে দরকষাকষি করা গেছে।’

এই ব্যয় সাশ্রয়ের প্রভাবের বিষয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘জ্বালানী তেলের আন্তর্জাতিক দর এবং প্রিমিয়াম ব্যয় হিসেব করেই গ্রাহক পর্যায়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এখন যে পরিস্থিতি, বিশেষ করে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না। ব্যয় সংকোচনের কারণে আপাতত নতুন করে তেলের দাম না বাড়ালেও চলবে।’

বিপিসির ব্যয় সাশ্রয় গ্রাহক পর্যায়ে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান টিবিএসকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, কিছুটা প্রভাব পড়বে। তবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে প্রতিবেশী অঞ্চলের মূল্য পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেমন, কলকাতার চেয়ে কম মূল্যে দেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করা হলে পাচার হওয়ার সম্ভবনা থাকে। এজন্য এটি বিবেচনা করা হয়।’

সফল দরকষাকষি আমদানি ব্যয় কমাতে এবং দেশীয় জ্বালানি বাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ব্যয় সাশ্রয়ের ফলে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে গ্রাহক পর্যায়ে তাৎক্ষণিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button