ঝুঁকি এড়াতে বাতিল হচ্ছে ট্রেনের যাত্রা
![](https://miprobashi.com/wp-content/uploads/2023/12/1703300697-7a5cafa2eebdd4478fc40bf310fbaef7.webp)
ঝুঁকি নিয়ে চলছে যাত্রীবাহী ট্রেন। গত আট দিনে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য তিন জোড়া ট্রেনের যাত্রা বাতিল করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। আরো দুই জোড়া ট্রেনের চলাচলের পথ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। তবে কোনো পথেই একেবারে ট্রেন চলাচল বন্ধ করা হয়নি। রাতের ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হলেও দিনের যাত্রা স্বাভাবিক আছে।
পাশাপাশি রেলপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যাত্রীবাহী মূল ট্রেনের আগে ডামি ট্রেন চালাচ্ছে রেলওয়ে। প্যাট্রলিং ও ডামি ট্রেন চালাতে অতিরিক্ত লোকোমোটিভের প্রয়োজন হচ্ছে। যাত্রা বাতিল করা ট্রেনগুলোর ইঞ্জিন প্যাট্রলিংয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গত দুই মাসে চলতি ট্রেনে ছোট-বড় অন্তত ৩০টির বেশি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটেছে। রেললাইন কেটে ফেলা, নাট-বল্টু ও ফিশপ্লেট খুলে ফেলা, ট্রেনে আগুন, ককটেল নিক্ষেপ, রেলপথে প্রতিবন্ধকতা তৈরিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে ট্রেনের যাত্রা বাতিলের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
অবশ্য রেলওয়ের দায়িত্বশীলদের দাবি, যেসব ট্রেনে রাতে যাত্রী কম হয় শুধু ওই ট্রেনগুলোর যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। এর সঙ্গে নাশকতার সরাসরি সমপর্ক নেই। তবে ঝুঁকি বিবেচনায় এমন অপ্রয়োজনীয় ট্রেনের চলাচল আরো বন্ধ হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো ট্রেনের চলাচল বন্ধ করা হয়নি। ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। রাতের বেলায় ফিরতি পথে তেমন যাত্রী হয় না। ট্রেনের বগিগুলোর জানালা ভালো না, অনিরাপদ। রেলপথ অনেকটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্যাট্রলিং করা কঠিন। মূলত এই চার কারণে রাতের যাত্রা বন্ধ রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত প্রতিদিন আট জোড়া কমিউটার ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে রাতে চলাচল করা এক জোড়া ট্রেনের যাত্রা বাতিল করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে এই ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়।
ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুর পর্যন্ত চলাচল করা এক জোড়া লোকাল ট্রেনের পথ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এই ট্রেনটি এখন ঈশ্বরদী যাচ্ছে না। গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে যাত্রা পথ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজশাহী থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর পথে চলাচল করা উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়। তবে এই পথে চলাচলকারী বরেন্দ্র এক্সপ্রেস, তিতুমীর এক্সপ্রেস ও বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস ট্রেনের চলাচল স্বাভাবিক আছে।
উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেনটির চলাচল বন্ধ প্রসঙ্গে সহকারী চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পশ্চিম) মো. আব্দুল আওয়াল স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ তথা নাশকতা এড়ানোর লক্ষ্যে সাময়িক বন্ধ থাকবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তাকুলদার বলেন, ‘বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এই ট্রেন চালানো নিরাপদ মনে করছি না।’
গত ১৫ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর পথে চলাচল করা এক জোড়া লোকাল ট্রেনের যাত্রা বন্ধ রয়েছে। এই দিন থেকে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকায় ঢুকছে না। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের তারাকান্দা পর্যন্ত চলাচল করে যমুনা এক্সপ্রেস। এখন ট্রেনটি তারাকান্দা থেকে জামালপুর পর্যন্ত চলছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, নাশকতার জন্যই ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে না। তাহলে তো সব ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হতো। যেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন সেগুলোর চলাচল বাতিল করা হচ্ছে। এসব ট্রেনে রাতে যাত্রী তেমন হয় না। কিন্তু দিনে তো স্বাভাবিক চলছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে কামরুল আহসান বলেন, ‘চিঠিতে নাশকতা, হরতাল-অবরোধ—এই জাতীয় শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে কি না আমি জানি না। কিছুটা হলেও নাশকতার ঝুঁকি রয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু শুধু নাশকতার আশঙ্কায় ট্রেন বন্ধ হচ্ছে না।’
আগে ডামি, পেছনে ট্রেন
রেলপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যাত্রীবাহী মূল ট্রেনের আগে ডামি ট্রেন চালাচ্ছে রেলওয়ে। সেই ডামি ট্রেনে কখনো শুধু একটি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) চালানো হচ্ছে। আবার কখনো এক-দুটি কোচও (বগি) যুক্ত করা হচ্ছে। যদি লাইনে ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে যাত্রীবাহী ট্রেনটি রক্ষা পাবে, এমন ভাবনা থেকেই এই উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে।
ময়মনসিংহ, লাকসাম, আখাউড়া, কুমিল্লা, ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন করিডরে রাতের বেলায় এমন ডামি ট্রেন চালানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে আন্ত নগর ট্রেন চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ পথগুলোতে শুধু লোকোমোটিভ চালিয়ে প্যাট্রলিং করা হচ্ছে।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন) সরদার শাহাদাত হোসেন বলেন, প্যাট্রলিং ও ডামি ট্রেন চালাতে অতিরিক্ত লোকোমোটিভের প্রয়োজন হচ্ছে। যাত্রা বাতিল করা ট্রেনগুলোর ইঞ্জিন প্যাট্রলিংয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পূর্বাঞ্চলে ২৫০, পশ্চিমাঞ্চলে ১৫০ ঝুঁকিপূর্ণ স্পট চিহ্নিত
যমুনা নদীতে ভাগ হয়েছে দেশের রেল পরিচালনা। যমুনার পূর্ব অংশকে বলা হয় রেলের পূর্বাঞ্চল আর পশ্চিমাঞ্চলকে বলা হচ্ছে পশ্চিমাঞ্চল। সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে মোট ৪০০টি জায়গা চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ২৫০ ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫০টি। নিরাপত্তার স্বার্থে এসব চিহ্নিত করা জায়গার নাম খোলাসা করবে না রেলওয়ে।
জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ১৫০টি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে নিরাপত্তার জন্য এক হাজার ৩০০ আনসার সদস্য বরাদ্দ পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা করে তাঁদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
পূর্বাঞ্চলে ২৫০টি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ১৬৮টি জায়গাই চট্টগ্রাম বিভাগে। চট্টগ্রাম বিভাগের এসব জায়গায় এক হাজার ১৫৭ জন পুলিশ ও আনসার সদস্য মোতায়েনের ব্যবস্থা নিচ্ছে রেলওয়ে।
বিশেষ করে রাত ১১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত রেলওয়ে ট্র্যাকগুলো নিবিড়ভাবে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে প্যাট্রলিংয়ের জন্য ‘মোটর ট্রলি ও লোকাল ট্রেনের ইঞ্জিনের ব্যবস্থা’ করতে হবে।
সহজ প্রবেশে ঘটছে বড় দুর্ঘটনা
দেশে তিন জাহার ৯৩ কিলোমিটার রেলপথ আছে। আর রেললাইন আছে চার হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার। দেশের ৪৩ জেলায় রেলপথ রয়েছে। এর ৩৯ জেলাতেই কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছে রেললাইন। সবচেয়ে বড় সমস্যা বেশির ভাগ রেলপথে প্রবেশের ক্ষেত্রে কাউকে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয় না। কারিগরি ভাষায় বলা হয়, ‘এক্সেস কন্ট্রোল’ নেই।
ফলে যেকোনো সময় যে কেউ রেললাইনে ঢুকে আঘটনের কারণ হতে পারে। যেমন—রেললাইন কেটে ফেলা, নাট-বল্টু খুলে ফেলা ইত্যাদি। এ ছাড়া দেশের পুরনো, তুলনামূলক দুর্বল রেললাইনে সহজে ক্ষতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা যায়। বেশির ভাগ রেলস্টেশনে সর্বসাধারণের প্রবেশে কোনো বাধা নেই। এমন অবস্থায় রেলের নিরাপত্তা ও যাত্রীর নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব কি না সেই প্রশ্নও উঠছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ২০টি অগ্নিসংযোগের এবং আটটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ও রেললাইনের ফিটিংস খুলে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চল রেলে বড় পাঁচটি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে।
গত ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়, দুটি কোচে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর পর ১৯ নভেম্বর জামালপুরের সরিষাবাড়িতে যমুনা এক্সপ্রেসে পরিকল্পিত নাশকতা করা হয়েছে। এই দুই ঘটনায় কোনো প্রাণহানি না হলেও বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
গত ২২ নভেম্বর সিলেটে উপবন এক্সপ্রেসে আগুন ধরানো হয়। ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে ২০ ফুট রেলওয়ে ট্র্যাক কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনায় একজন যাত্রী মারা যায় এবং ৫০ জন আহত হয়। ১৯ ডিসেম্বর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তিনটি কোচ পুড়ে যায়। চারজন মারা যায়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, রেলের অবকাঠামো তৈরিতে যতটা মনোযোগ, নিরাপত্তায় ঠিক ততটাই ঘাটতি রয়েছে। এখন প্রযুক্তির যুগ, দুটি রেন্সর ব্যবহার করলেই রেললাইন কাটার বার্তা পাওয়া যায়। তা হলে কেন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে না।
মো. হাদিউজ্জামান বলেন, এই ধরনের পরিকল্পিত নাশকতার অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত। কিন্তু ২০১৩-১৪ সালেও এমন ঘটনা ঘটেছে। এরপর নাশকতা প্রতিরোধে রেল কী ব্যবস্থা নিয়েছে সেটিও তদন্ত করে দেখা দরকার। নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা তো ছিল। রেল কেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিল না। মোট বিনিয়োগের দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ নিরাপত্তায় করলে পুরো রেলকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা যাবে।