ঝুলে আছে জুলাই সনদের ভাগ্য

আগামী ১৫ই আগস্ট শেষ হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ। এখনো চূড়ান্ত হয়নি জুলাই সনদ। এ নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে টানাপড়েন। বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। রাষ্ট্র সংস্কার ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কমিশনগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। ২৮শে জুলাই প্রাথমিক সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো হয়। এরপরই শুরু হয় মতবিরোধ। আইনি কাঠামো ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করেছে কমিশন। ৬৮ দিনের সংলাপ ও আলোচনার পরও জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে পূর্ণ ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারেনি কমিশন। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সনদ চূড়ান্ত না হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার আশঙ্কা করছেন রাজনীতিবিদরা। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) স্পষ্ট জানিয়েছে- সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি ছাড়া তারা এই সনদে স্বাক্ষর করবেন না। তাদের যুক্তি, কাগজে কলমে প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়; আইনি ভিত্তি দিতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় থেকেই এই সনদের বাস্তবায়ন করতে হবে। জুলাই সনদের ভিত্তিতেই হবে আগামীর জাতীয় নির্বাচন। কোনোভাবেই এই জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আগামী সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। বিএনপি বলছে, জুলাই সনদের খসড়ার কিছু শব্দ-বাক্যগত বিষয় তারা সংশোধনের জন্য বলেছেন। আগামী সরকার ২ বছরের মধ্যে এই সনদ বাস্তবায়ন করার যে কথা খসড়ায় বলা হয়েছে, এ বিষয়ে একমত দলটি।
রোববার তৃতীয় দফার বৈঠকে ছয়জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনায় সনদ বাস্তবায়নের বিকল্প পথ নিয়ে আলোচনা করে কমিশন। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- গণভোট, সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স মতামত গ্রহণ, বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থা, অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন।
অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতার কথাও উঠে এসেছে। অনেকের মতে, সরকার চাইলে এখনই কিছু সুপারিশ অধ্যাদেশে বাস্তবায়ন করতে পারে, কিন্তু পরবর্তী সরকার সংসদে অনুমোদন না দিলে এসব কার্যকারিতা হারাবে। তাই সনদকে আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রথম পর্বে (২০শে মার্চ-১৯শে মে) ৩৩টি দলের সঙ্গে আলোচনায় ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়। দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি রাজনৈতিক দল (৩রা জুন-৩১শে জুলাই) বাকি ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ১১টিতে ঐকমত্য এবং ৯টিতে নোট অব ডিসেন্টসহ সিদ্ধান্ত হয়। এখন এসব সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে আলোচনা চলছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, প্রাথমিক একটা খসড়া দেয়া হয়েছে সবাইকে, সে খসড়া অনুযায়ী তারা মন্তব্য করেছেন। খসড়া থেকে এসব মন্তব্যের ভিত্তিতে ‘সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ খসড়া’ আবার পাঠাবো আগামী দুদিনের মধ্যে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সবাই একমত হয় স্বাক্ষরের দিন-তারিখ ঠিক করা যাবে।
কবে নাগাদ জুলাই সনদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেটা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের আলোচনার তৃতীয় পর্বে, বিশেষত বিশেষজ্ঞদের মতামত পাওয়ার পর। আমরা যেটা বলেছি, কমিশনের মেয়াদ নির্ধারণ করবে সরকার। সরকার যদি মনে কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, সরকার সে সিদ্ধান্ত নেবেন।
সময়ের চাপ ও রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ: প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মধ্যদিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে সংস্কার ও জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আগস্টের ১৫ তারিখে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সনদ চূড়ান্ত না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জুলাই সনদ এখন কেবল রাজনৈতিক নথি নয়, আসন্ন নির্বাচনের আগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি হয়ে পড়েছে। এর বাস্তবায়নও জরুরি।
২০২৫ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় মাসের জন্য কাজ শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। স্বভাবতই কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ১৫ই আগস্ট। প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য ছিল, চলতি বছরের জুলাই মাসের মধ্যে সনদ চূড়ান্ত করা হবে। কিন্তু তা হয়নি, মেয়াদের একদম দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে কমিশন। এখন যদি ঐকমত্যে পৌঁছে চূড়ান্ত সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর করা সম্ভব না হয়, তখন সনদের ভাগ্যে কী থাকছে, এই আলোচনাও উঠবে রাজনৈতিক মহলে।
নির্বাচন-ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এর আইনি বাধ্যবাধকতা কী হবে, এটার সমাধান খুঁজতেছি। সরকার সিদ্ধান্ত নেবেন কী করতে হবে। আমরা ভাবিনি এই প্রশ্নগুলোর সুরাহা করতে হবে আমাদের।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান মানবজমিনকে বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে সনদের মধ্যে যে ঘাটতিগুলো রয়েছে- সেগুলো পূরণ করতে হবে। শুধু কাগজে স্বাক্ষর করলে হবে না। এই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনের এখনকার প্রক্রিয়া ধীরগতির। কমিশন সময় রক্ষা করতে পারছেন না। আমরা যতদ্রুত সম্ভব জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে চাই। ভালো কাজের জন্য কমিশনের মেয়াদ যদি চলতি মাস বাড়ানো হয়, তাহলে ঠিক আছে। তবে এই যাত্রাকে প্রলম্বিত না করাই ভালো।