Hot

টাইম বোমায় ভাসছে ঢাকা

পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে বেইলি রোড। ট্র্যাজেডি আসে, ট্র্যাজেডি যায়। মৃত্যু আর আহাজারিতে ভারী হয় ঢাকার বাতাস। এসব দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তির মূলে রয়েছে নগরের বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা। মানুষের সুরক্ষার কথা চিন্তা না করে শহরে গড়ে উঠছে বড় বড় অট্টালিকা। গ্রিন কোজি কটেজের মতো শহর জুড়েই ভবনে ভবনে গড়ে উঠেছে হোটেল-রেস্তরাঁ। এসব ভবনে চুলার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সিলিন্ডারের গ্যাস। ক্রেতাদের উঠানামার সিঁড়ি বা লিফট নেই পর্যাপ্ত। এ কারণে এসব ভবন হয়ে উঠেছে অনেকটা টাইম বোম। 

বেইলি রোডেই রাস্তার দু’পাশেই অসংখ্য রেস্তরাঁ। এসব রেস্তরাঁর ভবনে আছে আবাসিক ফ্ল্যাটও।

কোনো কোনো ভবনের নিচে বা উপরে আছে বিভিন্ন পণ্যের দোকান। বৃহস্পতিবার গ্রিন কোজি কটেজ নামে বহুতল ভবনে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। ওই ভবনটির আশপাশে একই ধরনের বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন রয়েছে। কিছু ভবনের প্রথম ৪ থেকে ৫ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয়। সেখানে ভাড়া দেয়া হয়েছে রেস্তরাঁ, কফিশপ কিংবা শপিংমল। রেস্তরাঁর কর্মীরা জানান, ওই এলাকায় অন্তত ৫০টি রেস্তরাঁ রয়েছে। একাধিক বহুতল ভবনে অন্তত ৮ থেকে ১০টি করে রেস্তরাঁ রয়েছে। রেস্তরাঁয় রান্নার কাজে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি রেস্তরাঁগুলোর মাঝে কাঁচের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা। নেই ভেন্টিলেশনের কোনো ব্যবস্থা। ওয়াসিস রেস্তরাঁর একজন কর্মী বলেন, এই ভবনে বার্গার এক্সপ্রেস, সেশিয়েট, ক্যাফে জেলাটেরিয়া নামের রেস্তরাঁ রয়েছে। শুধু আমরা ছাড়া ভবনের সবাই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে। আগুন লাগা গ্রিন কোজি কটেজের পাশেই আরেকটি বহুতল ভবন রয়েছে। এই ভবনেও কেএফসি, পিজ্জাহাট, দোসা এক্সপ্রেস, সেভেন পিক, থ্রিথ্রি ও সিক্রেট রেসিপি নামের রেস্তরাঁ রয়েছে। ভবনটিতে আন্ডারগ্রাউন্ডের পেছনের অংশে অরক্ষিত অবস্থায় একাধিক গ্যাসের সিলিন্ডার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে দেখা গেছে। তবে এসব সিলিন্ডারে গ্যাস না থাকার কথা জানান সেখানকার এক কর্মী। ওই ভবনের চতুর্থতলার রান্নাঘরে সারি সারি গ্যাসের সিলিন্ডার রেখে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভবনের একটিমাত্র সিঁড়ি ঘেঁষেই এমন অবস্থা দেখা গেছে। 

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, আশপাশের বিল্ডিংগুলোকেও সতর্ক করা হয়েছে। আবারো টিম যাবে। আবার তাদের সতর্ক করা হবে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। আমরা মানুষকে সচেতন করার জন্য যা যা করার দরকার তাই করি। রাজউক, সিটি করপোরেশন, তিতাস যে যার যার ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করলে আর আমরা সচেতন হলে এই ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে পারি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক মানবজমিনকে বলেন, আশপাশের সব ভবনেই আমরা নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু আমরা তো জোর করে তাদের উচ্ছেদ করতে পারছি না। আমরা নোটিশ দিচ্ছি এবং অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিচ্ছি। ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন করার জন্য তাদের বার বার তাগাদা দিচ্ছি। এসব বিষয় আমাদের মন্ত্রণালয়েও জানিয়ে দিচ্ছি।


রাজধানীর ধানমণ্ডির গাউছিয়া টুইন পিক। ১৬ তলাবিশিষ্ট এই ভবনে কাপড়ের দোকান, শোরুমসহ অন্তত দেড় ডজন রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ছয়টি বড় বাফেট লাউঞ্জ। বাকিসব চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। এসব রেস্টুরেন্টের রান্নাও করা হয় এই ভবনেই। তবে নেই ন্যূনতম অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। কয়েকটিতে দু-একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও কর্মচারীরা জানেন না ব্যবহারবিধি। এমন বেশ কিছু ভবন রয়েছে ধানমণ্ডিতেই। সাতমসজিদ রোডের দুই পাশেও অসংখ্য আবাসিক ভবনে রয়েছে নামিদামি রেস্টুরেন্ট। ধানমণ্ডির ১৫/এ- তে এমন একটি ভবন রয়েছে, যার স্থপতি মুস্তাফা খালিদ। তিনি শুক্রবার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অনুরোধ করেছেন কেউ যেন ওই ভবনে না যান। কারণ হিসেবে বলেছেন, ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। নকশা এবং অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সার্বিকভাবে একে সমূহ অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে। 

ঢাকার খিলগাঁও এলাকা। গত কয়েক বছরে ওই এলাকাটি আবাসিক থেকে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকে রূপ নিয়েছে। কোথাও নেই কোনো রকম অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। ওই এলাকার প্রধান সড়ক যেটি শহীদ বাকী সড়ক নামে পরিচিত তার দুই পাশে শত শত রেস্তরাঁ গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবনে। এমনও ভবন আছে যার প্রত্যেক ফ্লোরে রয়েছে রেস্টুরেন্ট। কোনো কোনো ভবনের ছাদেও করা হয়েছে রেস্তরাঁ। উঠানামার জন্য বানানো হয়েছে দুই-তিন ফুট চওড়া অস্থায়ী সিঁড়ি। লাগানো হয়েছে ওয়ানটাইম লিফটও। আবার এমন ভবনও আছে  যেখানে রেস্তরাঁ, আবাসিক ফ্ল্যাট এমন কি শিশুদের স্কুলও আছে। 

ঢাকার সর্বত্রই এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তরাঁ, শপিংমলসহ আবাসিক-বাণিজ্যিক সংমিশ্রণের ভবনগুলো। ফায়ার সার্ভিসের চালানো একটি সমীক্ষা বলছে, রাজধানীর ৯০ শতাংশ ভবন অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ২৩ শতাংশ ভবন। বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ব্যানার টানাতেও দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিসকে। তাতেও টনক নড়েনি কারও। মালিকরাও গুরুত্ব দিচ্ছেন না ফায়ার সার্ভিসের দেয়া সতর্ক বার্তাকে। 

ভবনের সুরক্ষা প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, ভবন তৈরি করতে প্রাথমিক নিয়মই অনেকে মানে না। ভবন তৈরির পর আরও কিছু কাজ থাকে। ফায়ার সেফটির কাজ থাকে। সেগুলোও অনেকে মানতে চায় না। আমরা সতর্ক করছি। নোটিশ দিচ্ছি। সামগ্রিকভাবে সবাই সচেতন না হলে তো হবে না। সিকিউরিটিকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয়, সেফটিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা ফায়ার সেফটির প্ল্যান দেই। এটা একটা প্রেসক্রিপশনের মতো। বাণিজ্যিক ভবন, শিল্প ভবন কিংবা আবাসিক ভবন অনুযায়ী আমরা আলাদা প্ল্যান দেই। সেটা দেখে বাস্তবায়ন করলে ভবন সুরক্ষিত থাকে। 

বেইলি রোডের ঘটনাটি দুর্ঘটনা নয় বরং অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, বিশৃঙ্খলার মধ্যদিয়ে অব্যবস্থাপনার নগরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। রাজউকসহ ছয়টি সংস্থা ভবনের বিভিন্ন অনুমোদন দেয়। কিন্তু এই অনুমোদন অনুযায়ী ভবনগুলো যথাযথ হচ্ছে কিনা, ব্যবহার হচ্ছে কিনা এগুলো দেখভাল না করার কারণে চোখের সামনে এই ধরনের মৃত্যুকূপগুলো তৈরি হচ্ছে। এগুলো হলো অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। এসব হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার, প্রতিকার বা প্রতিরোধ গড়ে তোলা যদি না হয় তাহলে তার পুনরাবৃত্তি হবে সেটাই স্বাভাবিক। বৃহস্পতিবার তাই হয়েছে। এটা অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড ছাড়া অন্যকিছু নয়। 

তিনি বলেন, একইরকম অসংখ্য ভবন বেইলি রোড, সাত মসজিদ রোড, বনানী-১১ অথবা মিরপুর-২ এ তৈরি হয়ে ‘টাইম বোমা’র মতো বসে আছে। রান্না প্লাজার মতো ঘটনা আমাদেরকে মাত্র দেড় বছরে পুরো একটি শিল্পখাতকে কমপ্লায়েন্স এ পরিবর্তন করে ফেলেছে। এতে বোঝাই যাচ্ছে আমাদের সামর্থ্য রয়েছে। শুধুমাত্র সিরিয়াস রাজনৈতিক ইনটেনশন দরকার। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এর উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করি না। ফায়ার সার্ভিসের বার বার নোটিশ দেয়া প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা কি করে বলে তাদের (গ্রিন কোজি কটেজ) নোটিশ দিয়েছি। তাদেরকে তো সনদও দেয়া হয়েছে। সনদ দিলো কে?

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ঢাকা বিভাগের উপ-সহকারী পরিচালক মো. তানহারুল ইসলাম বলেন, রেস্তরাঁ করতে হলে বাণিজ্যিক ভবনে করতে হবে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের একটা লাইসেন্স নিতে হবে। আবাসিক ভবনে রেস্তরাঁ করা যাবে না। রেস্তরাঁ করলেও লাইসেন্স দেয়া হবে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d