টাক মাথায় চুল লাগানো আর জিমে সময় কাটছে পলাতক আওয়ামী নেতাদের

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের এক বছর। দিশাহারা আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাকর্মীরা। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে। তারা সেখানে বাসা ভাড়া করে থাকছেন। কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন বন্ধু বা স্বজনের বাসায়। সাধারণ মানুষের নজর এড়াতে তারা খুব একটা বাইরে বের হচ্ছেন না। বাসায় বসেই অনলাইনে মিটিং করছেন। জিমে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছেন। রাঁধুনি না আসলে নিজেরাই রান্না করে খাচ্ছেন। এমন সব তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম দ্য প্রিন্ট।
খবরে বলা হয়, পতিত সরকারের এসব নেতার বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে হটিয়ে হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার ফন্দি-ফিকির করছেন তারা। সম্প্রতি দ্য প্রিন্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব কথা। পতিত সরকারের বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-এমপি’র সঙ্গে কথা বলেছে ভারতীয় এই গণমাধ্যম। এর মধ্যে সাবেক তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতও আছেন। পলাতক ওই নেতা জানান, লক্ষ্য এখন একটাই বাংলাদেশ পুনরায় পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা।
পতিত সরকারের এই নেতা বলেন, আমার এখন ঘুমানোর সময় নেই। মাঝে মাঝে আমি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাই। প্রতিটা দিন আমার কাজ আর কাজ, শুধু কাজের মধ্যেই কেটে যাচ্ছে।
গত বছর ছাত্র নেতৃত্বাধীন এক অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। সে সময় যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ ১৩০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যার জন্য দায়ী। হত্যার দায় অস্বীকার করা দলটি নিজেদেরকে পুনর্গঠিত করতে কলকাতায় প্রতিনিয়ত মিলিত হচ্ছেন এবং রাজনৈতিক চাল চালছেন। বাংলাদেশ থেকে শুধু আওয়ামীপন্থি রাজনৈতিকরাই পালিয়ে যাননি, তাদের সঙ্গে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, অ্যাক্টিভিস্ট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ বহু কূটনীতিকও দেশ ছেড়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পলাতকদের সংখ্যা দুই হাজারের কম হবে না।
এদের বেশির ভাগই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। আর ভারতে যাওয়াদের মধ্যে বেশির ভাগ কলকাতার নিউ টাউনে অবস্থান করছেন। প্রশস্ত রাস্তা, সাশ্রয়ী মূল্যে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া, উন্নত শপিং মল, ফিটনেস সেন্টার এবং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় নিউ টাউন তাদের জন্য একটি আদর্শ আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। ভারতে পালিয়ে আদর্শ মানুষের জীবনযাপন করছেন তারা। প্রত্যুষে উঠে নিয়মিত হাঁটা-চলা বাদ যাচ্ছে না। আর হাসিনাকে দেশে ফেরানোর আশায় দেশে-বিদেশে অনলাইনে মিটিং করে বেড়াচ্ছেন। বলা চলে পুরো রুটিন ওয়ার্কের মধ্যেই সময় পার করছেন তারা। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও আছেন। আগস্টের পর গত অক্টোবরে নিউ টাউনে প্রথম নিজেকে প্রকাশ করেন পলাতক এই নেতা।
এখানে আরাম করতে আসিনি: ২০২৪ সালের ২রা অক্টোবর খবর আসে কলকাতার নিক্কো পার্কে দেখা গেছে বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। মুহূর্তের মধ্যে সারা বাংলাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে যে খবর। কেননা কেউই তাকে দেশ ছাড়তে দেখেনি। বিপাকে পড়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তারা জনতাকে বোঝাতে হিমশিম খাচ্ছিল। সবার একটাই প্রশ্ন- কীভাবে ঢাকা থেকে পালিয়ে কলকাতায় উদ্ভাসিত হলেন কামাল। ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে অনুষ্ঠিত ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সময়কার হত্যা-সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি মামলায় কামালের নাম উঠে আসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর যে কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপি’র খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না, তাদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন।
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) শাহ আলম স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি। যদি তারা ইমিগ্রেশন পার হয়ে আসতেন, তাহলে আমাদের কাছে প্রমাণ থাকতো। আওয়ামী লীগের যেসব মন্ত্রী-এমপি দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন সে বিষয়ে তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। কেউ কেউ এখনো দেশে আছেন, এবং অনেককে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা গ্রেপ্তার করেছে।
নিউ টাউনে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সাবেক এক এমপি দ্য প্রিন্টকে জানান, তিনি কামালের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করেন। তার মতে বাংলাদেশের সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন এই এলাকায় একটি প্রশস্ত অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছেন, যেখানে তিনি তার দলীয় সহকর্মী এবং এখনকার নিউ টাউনের প্রতিবেশীদের নিয়মিত আপ্যায়ন করেন। কামাল তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় থাকেন এবং প্রতি সপ্তাহে দিল্লিতে দলীয় বৈঠক এবং ভারতের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তার ছেলে সাফি মুদ্দাসসির খান জ্যোতিকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয়।
সাবেক ওই এমপি’র মতে, নেতাকর্মী এবং দলের সদস্যদের মনোবল ধরে রাখার দায়িত্ব পেয়েছেন কামাল। তিনি বলেন, আমরা এখানে আরাম করতে বা অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকতে আসিনি। আমরা এখানে এসেছি বেঁচে থাকতে এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিনিয়ত এ বার্তাই পৌঁছে দিচ্ছেন কামাল।
গোপন পার্টি অফিস: পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে, কক্সবাজারের সাবেক এক আওয়ামী লীগ এমপি বলেন, তাদের জীবন এখন একটি ছন্দে বাঁধা পড়েছে। বলেন, আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি এবং আমার ৩-বেডরুমের এপার্টমেন্টে ফজরের নামাজ পড়ি। যেখানে আমি আরেকজন আওয়ামী লীগ এমপি’র সঙ্গে থাকি। তারপর আমরা দু’জনেই আমাদের এলাকার ফিটনেস সেন্টারে যাই। আমি ভারোত্তোলন করি, আর আমার ফ্ল্যাটমেট পিলাটেস ক্লাসে ভর্তি হয়েছেন।
১৫০০ বর্গফুটের এপার্টমেন্টটির ভাড়া প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা। যা ওই সাবেক এমপি’র কাছে খুব বেশি মনে হয় না। তবে তাদের ছোট একটি সমস্যা হলো রাঁধুনি রান্না না করেই মাঝে-মধ্যে ছুটি কাটান। ওই এমপি বলেন, আমি রান্না করতে অভ্যস্ত নই। আমার ফ্ল্যাটমেটও নন। কিন্তু যেদিন আমাদের রান্না করতে বাধ্য হতে হয়, সেদিন আমি ভিডিও কলে ঢাকায় আমার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে রান্না সম্পন্ন করি। এটা আমার জন্য নতুন। কে জানে, হয়তো বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার পর আমি একজন রাঁধুনি হিসেবে নতুন পেশা শুরু করবো। দুপুরের খাবারের পর একটু বিশ্রাম নেন তারা। এরপর সন্ধ্যাগুলো কাটে বাংলাদেশ, ভারত এবং অন্যান্য দেশের আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে অনলাইন মিটিং করে।
সমপ্রতি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো কলকাতায় বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের একটি গোপন পার্টি অফিস সম্পর্কে খবর দিয়েছে, যা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানে। তবে কক্সবাজারের সাবেক এমপি এই খবরটি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, হ্যাঁ নিউ টাউনে আমরা একটি জায়গা ভাড়া নিয়েছি যেখানে আমরা সবাই একত্রিত হই। কলকাতায় প্রায় ১৩০০ দলীয় নেতা আছেন। আমরা তো আর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বসার ঘরে সবার সঙ্গে দেখা করতে পারি না! কিন্তু এটাকে অফিস বলাটা হবে অতিরঞ্জন।
একটি উপন্যাস এবং একটি হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট: কলকাতার নিউ টাউন থেকে অনেক দূরে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হারুন আল রশিদ কানাডার অটোয়ার একটি শান্ত এলাকায় নতুন জীবন শুরু করেছেন। যদিও তিনি আওয়ামী লীগের সদস্য নন, তবে শেখ মুজিবুর রহমানের একজন সোচ্চার সমর্থক এবং ইউনূস প্রশাসনের একজন কঠোর সমালোচক। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, মরক্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত রশিদকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি দেশে ফিরতে দেরি করেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট করেন। তিনি বলেন, আমি আমার পোস্টের শিরোনাম দিয়েছিলাম, ‘বাংলাদেশের জন্য এবং আমার নিজের জন্য একটি আবেদন’। এর প্রতিক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার আমার এবং আমার পরিবারের পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়।
অটোয়ায় তিনি বেশির ভাগ সময় লেখালিখি করে কাটান। আমি যতটা চাই তার চেয়ে কম পড়ি, তবে বাড়ির কোথাও একটি বই খোলা রাখি। সকালের চায়ের সঙ্গে পাঁচ পৃষ্ঠা আর ঘুমানোর আগে সামান্য পাঠই আমার অভ্যাস। রশিদ জানান যে, তিনি এখন স্ব-কর্মসংস্থান করছেন, যা কখনো কখনো তার কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়। তিনি একটি সাধারণ বাজেট মেনে চলেন এবং এমন কাজ প্রত্যাখ্যান করেন যা তাকে বাড়ি থেকে বেশি দূরে নিয়ে যায়। তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইলগুলো বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক গতিপথ সম্পর্কে তার মতামত দিয়ে ভরা। ড. ইউনূস সম্পর্কে তার অভিযোগগুলোর ফাঁকে, রশিদ যখন তার ডেস্কে বসে একটি সুন্দর অনুচ্ছেদ লিখতে পারেন, তখন তার দিনটি সার্থক হয়। এ ধরনের দিনগুলোর ফলস্বরূপ তার প্রথম ফিকশন, বাংলাদেশ নিয়ে একটি ডিসটোপিয়ান উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছে।
সাবেক এক এমপি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে নিউ টাউনের একটি ২-বেডরুমের এপার্টমেন্টে একা থাকছেন। তার এই অবসর সময়কে টাক মাথায় চুল প্রতিস্থাপন করে কাজে লাগাচ্ছেন। ওই এমপি বলেন, ঢাকা থেকে পালিয়ে আসার সময় আমার চুল পড়া শুরু হয়। আমার স্ত্রী আমাকে বেশ কয়েক বছর ধরে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করতে বলছিলেন। কিন্তু একজন প্রথমবারের এমপি হিসেবে আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, ঢাকায় এর জন্য সময় বের করতে পারতাম না। তিনি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দিল্লি যান এবং দক্ষিণ দিল্লির একটি হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার থেকে একটি নতুন লুক নিয়েছেন। এই কঠিন সময়ে, নতুন চুল পাওয়াটা ভালো লাগার মতো একটি বিষয় বলে দ্য প্রিন্টকে জানান- ওই এমপি।