Hot

ট্রাইব্যুনালে ড. ইউনূস জানালেন বদলে দেয়ার স্বপ্ন: ভুল মানুষ তৈরি হচ্ছে.. দাসত্ব থেকে মুক্তি চাই’

সরকারই মামলা করেছে বলে মন্তব্য করেছেন নোবেল বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী অর্থর্নীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, সরকার বারবার বলছে এই মামলা সরকার করেনি। কিন্তু এই মামলা সরকার করল নাকি শ্রমিক করল আপনারা (সংবাদ মাধ্যম) তো কিছুই বললেন না। এর জবাবটা আপনি দিন। কলকারখানা অধিদপ্তর সরকারের। এ মামলা তারাই করেছে। শ্রমিকরা এ মামলা করেনি। তিনি বলেন, ভুল তত্ত্ব দিয়ে ভুল মানুষ তৈরি করা হয়েছে। চাকরি একটি দাসত্ব। আমরা এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে চাই।

তকাল রোববার রাজধানীর কাকরাইলস্থ শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে জামিন এবং শ্রম অধিদফতরের মামলায় দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে গিয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি। শ্রম আইন লঙ্ঘন মামলার রায়ে ৬ মাসের সাজার বিরুদ্ধে ২৫টি যুক্তি তুলে ধরে খালাস চান ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন। সেই সঙ্গে জামিন আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের স্থায়ী জামিন মঞ্জুর করেন।

আদেশের পর দীর্ঘ সময় কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। তিনি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত গ্রামীণ টেলিকমের অপর তিন সহযোদ্ধাকেও পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি বলেন, মামলায় চার জন আসামির একজন আমি। তিন জন কেউ আপনাদের সামনে আসেননি। তিনজনের কথা কেউ বলে না। একজন হলেন নূরজাহান বেগম। জোবরা গ্রামের নূর জাহান বেগম। আমার সামনেই আছেন। তাকে একটু দেখুন সবাই। গ্রামীণ ব্যাংক ওনার হাত দিয়ে জোবরা গ্রামে শুরু হলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, আমি শিক্ষক ছিলাম। তিনি বাংলা বিভাগে ছিলেন। তিনি এবং তার স্বামী। স্বামী ছিলেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। সেই থেকে যত ঘটনা ঘটেছে গ্রামীণ ব্যাংকের তার গোড়াতে তিনি ছিলেন। যেমন গ্রামীণ ব্যাংকের ১৬ সিদ্ধান্ত। এটি একটি চার্টার। গ্রামীণ ব্যাংকে বুঝতে হলে ওখানে যেতে হবে। সে অঙ্গীকার করছেন পরিবর্তন করার জন্য। যৌতুক প্রথার বিরোধিতা করা। এর ভিত্তিতে এটি হয়েছে সারা বাংলাদেশে। আজকে তাকে খেসারত দিতে হচ্ছে। এটি দু:খ আমার। গ্রামে বাচ্চাদের যত্ন নেয়া। তখন শিশুদের যে পরিস্থিতি ছিলো। তাকে ভিটামিন ‘এ’ নিয়ে আসা তার জন্য। শিশুরা যাতে রাতকানা রোগে না ভোগে। দেশে তখন সর্বত্র ছিলো রাতকানা রোগ। ১৬ সিদ্ধান্তের প্রতিটি সিদ্ধান্তের প্রতিটি জিনিসের পেছনে তিনি ছিলেন।

আজকে তাকে আমরা আদালতে নিয়ে এসেছি। প্রতি তারিখেই আমরা আসছি। গতবার যখন এসেছিলেন, তখন তিনি বার বারই জিজ্ঞেস করছিলেন যে, জেলখানায় আমরা কি নিয়ে যাবো ? কি কি নিতে পারবো ? নামাজের কাপড়টা নিতে পারবো কি না। ওষুধ নিতে পারবো কি না। গতবার কিন্তু তিনি সেই প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন। কারণ, আদালত থেকেই হয়তো আমাদের জেলে যেতে হবে। তাই সেই প্রস্তুতি তিনি নিয়ে এসেছিলেন। এই যে দুর্ভাগ্য আমাদের। যে সারা জীবন দিলো এটির জন্য। তাকে আদালতে যাওয়ার জন্য, জেলখানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হয়েছে। আমার সঙ্গী আছেন আরেকজন। শাহজাহান সাহেব। উনিও আসামি। গোড়া থেকে সঙ্গী আছেন গ্রামীণ ব্যাংকের। তিনি আছেন আমাদের সঙ্গে। তিনি হাটতে পারেন না। চলতে পারেন না। তাকে বহন করে ৬তলা পর্যন্ত ওঠাতে হয়েছে নামাতে হয়েছে। এটি আমাদের শাস্তি। আরেকজন হলেন, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন আশরাফ। সবাইকে চিনতে হবে। আমরা চারজনইতো আসামি। আরেকজন ছিলেন, আশরাফ সদ্য বুয়েট থেকে পাস করা। তাকে ধরে নিলাম। আমাদের একজন ইঞ্জিনিয়ার লাগবে একজন। বললাম তুমি আসো। সে বুঝতেছিলো না কি দিয়ে কি করবে। তাদের দায়িত্ব দিলাম। তখন গরিব মানুষের কোনো বাড়ি ছিলো না। সেইসব দিনের কথা হয়তো আপনাদের স্মরণ নেই। পাটখড়ি দিয়ে ঘর বানাতো মানুষ। পাটখড়ির চাল। পাটখড়ির দেয়াল।

তখন আমরা বললাম, গ্রামীণ ব্যাংকে যারা যোগ দেবে তাদেরকে পাটখড়ির ঘরে আর থাকবে না। তাদেরকে সুন্দর একটি বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেবো। আমরা গৃহঋণ শুরু করলাম। গৃহঋণ ছিলো ৫ হাজার টাকা, ৭ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। এই হলো গৃহঋণ। ক্রমে ক্রমে সে শোধ করবে। য’দ্দিন সময় লাগে। আশরাফকে বললাম, তুমি একটা ডিজাইন করো। কিভাবে ঘরটা বানাবে। আশরাফ নতুন মানুষ। তারপরও সে একটা বানালো। চারটা খুটির ওপর একটি টিনের চাল। এই হলো চার খুটি আর টিনের চালার ঘর। আমরা গৃহঋণ দিতে থাকলাম। মানুুষ উৎসাহী। তারা বললো, আগে আমরা গরুর সঙ্গে, ছাগলের সঙ্গে থাকতাম। এখন আমরা ঘর করেছি। টিনের চালের ঘরের মধ্যে থাকি। আমাদের তখন ধারণা ছিলো না এই চার খুঁটির টিনের চালের বাড়ি ‘আগাখান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার’ পেলো। বিশ্বের সেরা আর্কিটেকচার পুরষ্কার সেটা। ১৯৮৯ সালে এই পুরষ্কার লাভ করে। সেইবছর বাংলাদেশ আরেকটি আর্কিটেকচার পুরষ্কার পেয়েছিলো । সেটি হচ্ছে, লুই কানের পার্লামেন্ট। যেটা বিশ্বসেরা আর্কিটেক্ট। একই বছর একদিকে লুই কান পুরষ্কার পেলেন।

আমাদের আশরাফ পুরষ্কার পেলেন। তাকে নিয়েও আমরা হাজিরা দিচ্ছি প্রতিমাসে। এই যে গ্রামীণ ব্যাংক তৈরি হলো, এটি কি এমন যে আমরা মামলায় হাজিরা দিচ্ছি ? গ্রামীণ ব্যাংক ছিলো আমাদের একটি স্বপ্ন। যে আমরা পৃথিবীকে বদলাতে চাই। দরিদ্রকে মুছে ফেলতে চাইছি। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা আমরা পেছনে লেগেছিলাম। জানিনা ভবিষ্যতে আমাদের কি হবে না হবে ! আমাদের জানা ছিলো না ভবিষ্যতে আমরা এগিয়ে গেছি। খুঁটিনাটি দেখে দেখে আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। এভাবে গ্রামীণ ব্যাংক আস্তে আস্তে প্রসারিত হলো। এটি হয়ে গেলো আমাদের অপ্রত্যাশিত একটি বীজতলা। স্বপ্নের বীজতলা। আমরা স্বপ্ন দেখি আর বীজ বুনি এদের মধ্যে। কী হবে ভষ্যিতে ! এটি ক্রমে ক্রমে প্রসারিত করলাম নানা দিকে। এটিকে স্বাস্থ্যের দিকে নিয়ে গেলাম। প্রযুক্তির দিকে নিয়ে গেলাম। একটার পর একটা। আজকে যা কিছু হচ্ছে সবকিছু ছিলো গ্রামীণ ব্যাংক। ২০১১ সালে আমাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করে দেয়া হলো। ভাবলাম যে, বীজতলা রয়ে গেলো একদিকে। আমাদের লোকজন যারা স্বপ্নের পেছনে রয়ে গেছেন তারা যাবো কই ? আবার আস্তে আস্তে লোক জড়ো করলাম। এই যে প্রত্যেকটা জিনিস, আজকে আপনারা শুনছেন, আমরা করছি। কি করেছি আমরা ? আমরা বলছিলাম যে, চাকরির পেছনে মানুষ ঘুরবে না। চাকরি মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানুষ হলো একজন উদ্যোক্তা। তার জন্মই হলো উদ্যোক্তা হিসেবে। এই কাঠামো ভুল। এর পেছনে আমরা ছুটলাম। শুধুর ব্যাংকের ভুল থিওরির কারণেরৃ। কারণ চাকরিটা হলো দাসত্ব। একজন আরেকজনের জন্য খাটবে।

মাসের শেষে, দিনের শেষে তাকে কিছু ভাগ দেবে রোজগারের। অল্পস্বল্প। এটি মানুষের জন্য নয়। এই দাসত্ব থেকে আমরা মুক্তি পেতে চাই। আমরা নমুনা দিলাম গ্রামীণ ব্যাংকের মহিলাদের। দ্যাখো, গ্রামের অশিক্ষিত মহিলা। গ্রামের অশিক্ষিত মহিলা অল্পস্বল্প টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। কে বলে যে মানুষের উদ্যোক্তা হবার ক্ষমতা সকল মানুষের নেই ? তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে আসলাম। উদ্যোক্তা হবার জন্য। যেগুলো আমরা উদ্যোক্তা হিসেবে করছি। আমরা সেখনে চ্যালেঞ্জ করলাম। মূল অর্থর্নীতির তত্ত্বকে আমরা চ্যালেঞ্জ করলাম। একটি ভুল তত্ত্ব দিয়ে আমাদের ভুল মানুষ তৈরি করা হয়েছে। দারিদ্র এবং পৃথিবীর যত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তার গোড়ায় হলো আমাদের ভুল তাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা। সেটার পেছনে আমরা লাগলাম। আমরা স্বপ্ন দেখলাম। আমরা একটা ইমাজিনেশনকে গুরুত্ব দিলাম। মানুষের মূল শক্তি হলো ইমাজিনেশন।

ইমাজিনেশন না থাকলে কিছু হবে না। আমরা ইমাজিং করছি। স্বপ্ন দেখছি। সেটির পেছনে ছুটি। যে, এটি করা যাবে না কেন ? একটা সাহস নিয়ে আমরা পেছনে দাঁড়াই। এটিই হচ্ছে আমাদের মূল শক্তি। যার কারণে ব্যবসার তাত্ত্বিক কাঠামোতেই সমস্যা। মুনাফার সর্বোচ্চকরণ হলো ব্যবসা। আমরা বলছি, এটি ভুল তত্ত্ব। মানুষ এমন না যে মুনাফার নেশায় মুখ ছুঁয়ে যাবো। তাকে ভুল দিকে নেয়া হয়েছে। মুনাফার ড্রাগ তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কাজেই আমরা মূল মানুষকে আবিষ্কার করতে চাই। যে মূল মানুষ সে মানুষকে উপকার করতে চায়। তার ভেতরে এটি আছে। সেটিকে উন্মুক্ত করার জন্য ব্যবসাকে নতুন কাঠামোতে আনতে হবে। তখন আমরা করলাম ‘সামাজিক ব্যবসা’। একটার পর একটা সামাজিক ব্যবসা আসতে শুরু হতে থাকলো। ব্যবসার খাতিরে। শিক্ষার খাতিরে। শিক্ষায় সামাজিক ব্যবসা নিয়ে আসলাম। কারণ শিক্ষা ব্যবস্থা একটা চিন্তার কারাগার। এই কারাগার থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে ফেলতে হবে। প্রচলিত যে শিক্ষা তাতে চাকরির জন্য মানুষ লেখাপড়া করে। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য লেখাপড়া করে না। উদ্যোক্তা হতে হলে টাকা বা ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন সেটি আর্থিক ব্যবস্থা থেকে আসতে হবে। তাহলে মানুষ উদ্যোক্তা হতে পারবে। আমরা এসবের পেছনে ছুটছি। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রাথমিক যে দায়িত্ব সেটি আমরা পালন করছি। কারণ, ব্যবসা শুধু মুনাফার জন্য নয়। সামাজিক সমস্যা নিরসনের জন্য হতে হবে। আমরা এসব নিয়ে ছুটছি।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন অনেক কথাই নিজে থেকে বলতে চাইলেন। কিন্তু সংবাদকর্মীরা তাকে দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বরং বলুন, আপনি আরো বেশি করে বলুন..। সাংবাদিকরা তাকে ঘুরে ফিরে মামলার প্রসঙ্গে টেনে আনেন। তিনি রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, আমরা বৃহৎ কিছুর পেছনে ছুটছি। মামলা, রায়, কারাদণ্ড-এসবতো ক্ষুদ্র জিনিস।

পরে ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, আজকে আদালত আমাদের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন। নিম্ন আদালতের রায় সাসপেন্ড (স্থগিত) করেছেন। একইসঙ্গে আগামী ৩ মার্চ নিম্ন আদালতের সেসব নথি আনার জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছেন। আর আপিল শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে স্থায়ী জামিন দেয়া হয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button