ট্রাম্পের বিচার নিয়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বিভক্ত
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট বৃহস্পতিবার তিন ঘণ্টা ধরে পর্যালোচনা করেছেন, দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচার থেকে দায়মুক্তি পাবেন কি না এবং এমন সুযোগ থাকলে তার অর্থ আসলে কী দাঁড়ায় তা নিয়ে। এর জবাবই নির্ধারণ করবে, ২০২০ সালের নির্বাচনকে নস্যাৎ করার চেষ্টার অভিযোগে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিচারের মুখোমুখি হবেন কি না। তবে সিদ্ধান্ত যাই হোক, প্রত্যেক বিচারক ইঙ্গিত দিয়েছেন, এটিই যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনের গণতন্ত্রের নতুন রূপ দেবে। বিচারক নেইল গরশুচ বলেছেন, ‘আমরা একটি যুগের জন্য রায় লিখছি।
এ বিষয়ে আদালতের নির্ধারিত যুক্তি-তর্কের এক দিন পর বিশেষ অধিবেশনে মামলাটির শুনানি হয়েছে। এর ভিত্তি ছিল মূলত ট্রাম্পের এই দাবি—প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্তব্যরত থাকার সময় তিনি যেকোনো ফৌজদারি অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার যোগ্য। ট্রাম্পের মতে, এই দায়মুক্তিই হবে স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথের আনা অভিযোগ থেকে তার রক্ষাকবচ। এই দায়মুক্তি বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার পর্যন্ত তাঁর বিচার স্থগিত থাকবে।
জুনে বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ দিকে বিচারকরা যে প্রশ্ন তুলেছেন তা তাঁদের মধ্যে বিভক্তির একটি ইঙ্গিত মিলেছে। ফলে একটি বিভক্ত সিদ্ধান্তই আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁদের বিভক্তির জেরে আরো জটিল সিদ্ধান্তও আসতে পারে, যা পুনরায় বিচার শুরুর প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে।
তাঁদের প্রশ্নগুলো এটিও প্রকাশ করছে, রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং উদারপন্থী সংখ্যালঘু—উভয়ই ইতিহাসের দিকে চোখ রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে চান।
একটি পূর্ণ দায়মুক্তির অর্থ কি এই দাঁড়াবে যে ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকেও মেরে ফেলতে পারেন? কিংবা এই দায়মুক্তি না থাকলে প্রেসিডেন্ট মেয়াদ শেষে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হবেন বা জেলে যাবেন? ষাটের দশকে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ওয়াটেরগেট ঘটনা এবং জন এফ কেনেডির অপারেশন মনগুজের (ফিদেল কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা অভিযান) ঘটনায় ক্ষমা পাওয়ার বিষয়টিও তুলে আনছেন তাঁরা।
রক্ষণশীলরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টদের কিছুটা দায়মুক্তি থাকা উচিত। তবুও বিচারকরা এ মামলায় ট্রাম্পের আইনজীবী ডিন জন সাউয়ের যুক্তিতর্ক নিয়ে সতর্ক, যেখানে তিনি বলেছেন, একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচার প্রক্রিয়া থেকে ‘প্রায় সুরক্ষিত’। সাউয়েরকে এই সুরক্ষার বিষয়টি ধরে ৯ জন বিচারক জেরা করেছেন।
তিন উদারপন্থী বিচারকের একজন এলেনা কাগান প্রশ্ন করেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট যদি সামরিক বাহিনীকে অভ্যুত্থান ঘটাতে বলে তাহলে কী হবে?’ সাউয়েরকে বেশ দ্বিধান্বিত দেখা গেছে এর উত্তর দিতে গিয়ে। তিনি বলেছেন, ‘পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।’ বিচারপতি কাগান প্রত্যুত্তরে বলেছেন, ‘এটি খুব একটা ভালো শোনাচ্ছে না, তাই নয় কি?’
পরে আরেকজন উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত বিচারপতি কেতানজি ব্রাউন জ্যাকসনও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্টরা পুরো ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে থাকলে তারাতো আইন নাও মানতে পারেন। ‘আমি বোঝার চেষ্টা করছি, ওভাল অফিসকে (প্রেসিডেন্টের অফিস) অপরাধের আসনে পরিণত করাকে কিভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়।’
রক্ষণশীল বিচারকরাও সাউয়েরকে চাপ দেন, প্রেসিডেন্টের কাজ ও ব্যক্তিগত কাজের অংশ হিসেবে করা ‘অফিশিয়াল অ্যাক্ট বা সরকারি কাজ’ বলতে কী বোঝায়। আদালতের অন্যতম রক্ষণশীল বিচারক স্যামুয়েল আলিতো জানতে চান, ‘আমার প্রশ্ন হলো, দায়মুক্তির যে বিশাল আওতার কথা আপনি বলছেন সেটা প্রয়োজনীয় কি না?’
তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধি মাইকেল দ্রিবেনও একই ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ বিচারকরা এটিও চিন্তা করেছেন, কিছুটা সুরক্ষা না থাকলে মেয়াদ শেষ করা প্রেসিডেন্টের কী অবস্থা হবে। বিচারপতি ক্লেয়ারেন্স থমাস জানতে চান, বিদেশের মাটিতে সহিংস হামলার নির্দেশ যদি কোনো প্রেসিডেন্ট দেন তাহলে কী হবে, পরে কী তাঁর বিচার করা যাবে?
দ্রিবেন জানান, নিজের কাজের জন্য ফৌজদারি দায় থেকে সুরক্ষা পাওয়ার কয়েকটি স্তর কার্যকর আছে, যার আওতায় বিদেশের মাটিতে সংঘটিত কার্যক্রমও রয়েছে।
বিচারক আলিতো আরেকটি সম্ভাব্য পরিণাম নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন, প্রেসিডেন্ট দলীয় হামলারও শিকার হতে পারেন, তাঁর উত্তরসূরির দ্বারা কিংবা মেয়াদের শেষে অফিস ছাড়ার পর। শুনানির দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রধান ভূমিকা রাখা এ বিচারপতি বলেন, ‘এটা প্রেসিডেন্সিকেও ধ্বংস করতে পারে।’
রক্ষণশীল বিচারকরা একই অবস্থান ব্যক্ত করেননি। বিচারপতি এমি কোনে ব্যারেটকে নিয়োগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তাঁকে কিছুটা সন্দেহগ্রস্ত মনে হয়েছে, প্রেসিডেন্ট পূর্ণ দায়মুক্তি পাওয়ার অধিকারী কি না তা নিয়ে।
দ্রিবেন বলেন, প্রেসিডেন্টের দোষ ত্রুটি মোকাবেলায় ‘এখানে সম্পূর্ণ প্রশ্নমুক্ত কোনো পদ্ধতি নেই’। জাস্টিস ব্যারেট বলেছেন এ বিষয়ে তিনিও একমত।
তবে ট্রাম্পের আইনজীবী বা স্পেশাল কাউন্সেলের পক্ষে পুরোপুরি না যাওয়া কোনো বিভক্ত রায় বা নির্দেশনা, এই প্রশ্ন কিংবা এর অংশ বিশেষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিম্ন আদালতে পাঠাতে পারে। তখন এই আইনি লড়াই নিশ্চিতভাবেই বিলম্বিত হবে এবং আপিলে যাবে, যার অর্থ হলো এই আইনি লড়াই কয়েক বছর না হলেও কয়েক মাস ধরে চলবে।