ট্রাম্পের শুল্কনীতি : ৩ মাসে যা করতে পারে বাংলাদেশ

ট্রাম্পকে লেখা চিঠিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, উল্লেখযোগ্য কিছু মার্কিন রফতানি পণ্যের শুল্ক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পারস্পরিক শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করায় আপাতত স্বস্তিতে বাংলাদেশ। তিন মাসে কী কী করার আছে যার মাধ্যমে সঙ্কট এড়ানো যায়?
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্পের এই ‘শুল্কযুদ্ধের’ মূল উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। আর তাই শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে সেই হিসাবটিকেই বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। আগামী তিন মাসে সেটারই ফয়সালা করতে চাইবেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেকটি দেশের সাথে তাই আলাদাভাবে ‘ডিল’ করতে চাইছে। এখন ইউএসটিআই সেটা কত দিনে পারবে এবং তিন মাসের মধ্যে সেটা ফয়সালা করার মতো জনবল আছে কিনা সেই প্রশ্ন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চিঠি ও ফোনে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে এরইমধ্যে ‘ট্রেড গ্যাপ’ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর। ভিয়েতনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে শূন্য শুল্কের প্রস্তাব করেছে। আর কম্বোডিয়া মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে।
ট্রাম্পকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, উল্লেখযোগ্য কিছু মার্কিন রফতানি পণ্যের শুল্ক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে গ্যাস টারবাইন, সেমি-কন্ডাক্টর ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। তিনি বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন অ-শুল্ক বাধাও দূর করছে বলে জানান। সেগুলো হলো- পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা, প্যাকেজিং ও লেবেলিংয়ের নিয়ম সরলীকরণ এবং কাস্টমস পদ্ধতি সহজীকরণ।
বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮৪ ভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে। আর একক দেশ হিসবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রফতানি করে। গত বছরে মোট রফতানি পোশাকের ১৮ শতাংশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে।
মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই হিসাবে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতির পরিমাণ ৬১৫ কোটি ডলার।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘নতুন করে ৩৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর আগের ১৫ শতাংশ ধরে শুল্ক দাঁড়িয়েছিল ৫২ শতাংশ। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অর্ডার ক্যান্সেল হওয়া শুরু করেছিল। অন্যান্য শিল্প খাত, যেমন, চামড়া খাতেও অর্ডার ক্যান্সেল হয়েছিল। কিন্তু তিন মাসের একটা দম নেয়ার সময় পাওয়া গেছে। অর্ডারগুলো ফের বহাল হচ্ছে।’
তার কথা, ‘আমাদের তৈরি পোশাকের লিড টাইম হলো ৬০ দিন। উৎপাদন থেকে ক্রেতার কাছে সরবরাহ করতে এই সময় লাগে। ফলে যা শিপমেন্ট হয়েছে, পাইপ লাইনে আছে এবং অর্ডার পর্যায়ে আছে- সেই পোশাক নিয়ে আর কোনো সঙ্কট থাকলো না। কিন্তু তিন মাস পর কী হবে তা আমাদের ভাবতে হবে।’
‘সরকারের উচিত হবে প্রধান উপদেষ্টা তার চিঠিতে যা বলেছেন, তা দ্রুত বাস্তবায়ন শুরু করা, যাতে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপগুলো খুব দ্রুতই দৃশ্যমান হয়। সেটা হলে হয়তো এই শুল্ক পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। তবে সেটা কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে,’ মন্তব্য তার।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রধানত যে চারটি পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করি, তার মধ্যে শীর্ষে আছে স্ক্র্যাপ আয়রন। সেটা দিয়ে রড তৈরি হয়। এরপর ফুয়েল। এই দুইটি পণ্য মিলিয়ে ৫০ শতাংশ। এরপর আছে এডিবল অয়েল (সয়াবিন) ও কটন। এইসবে শুল্ক কম, কিন্তু অল্প আমদানি হয় এরকম পণ্যে ৭০০ শতাংশ শুল্কও আছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশ তাদের পণ্যে ৭২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিস)-এর গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা চারটি পণ্যই মোট আমদানির ৭৫ শতাংশ। এই পণ্যে শুল্ক অনেক কম। আমরা চাইলে এর আমদানি এক-দেড় মাসের মধ্যে দুইগুণ করে ফেলতে পারি। কারণ, স্ক্র্যাপ আয়রন, এলএনজি, সয়াবিন তেল, তুলা আমরা অন্য দেশ থেকেও আমদানি করি। আর এগুলোর বাংলাদেশে চাহিদাও আছে। আরো কিছু কৃষিপণ্য, যেমন, গম আমদানি আমরা বাড়িয়ে দিতে পারি। কানাডা থেকেও আমরা গম আনি। আরো অনেক ভোগ্য পণ্যের আমদানি বাড়িয়ে দেয়া যায়।’
‘আর প্রধান উপদেষ্টা তিনটি পণ্য গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ওপর শুল্ক ৫০ শতাংশ কমানোর কথা বলেছেন। এই শুল্ক কমানোর সাথে সাথে আমাদের শুল্ক কাঠামো নতুন করে সাজাতে হবে,’ বলেন তিনি।
বিশ্বের ৭৫টি দেশই এখন দেন-দরবারে অংশ নেবে। সবাই বাংলাদেশের মতোই তিন মাসের সুবিধা পেয়েছে। সুতরাং আলোচনার ক্ষেত্রেও একটা ইঁদুর দৌড় শুরু হবে। যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় কাজটি করবে তা এখানো স্পষ্ট নয়। কিন্তু যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে নেয়া তাদের ব্যবস্থা আগে দৃশ্যমান করবে, তারা এগিয়ে থাকতে পারে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)- এর নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘তিন মাস যে সময় পাওয়া গেল, তা আমরা অতটা আশা করিনি। পাওয়া গেল এটাই বড় কথা। কিন্তু পুরো পরিস্থিতি এখন আনএক্সপেক্টেড। ক্ষণে ক্ষণে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে আবার নতুন কী সিদ্ধান্ত আসে তা-ও আমাদের ভাবতে হবে। তাই এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের আগাম প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার।’
‘প্রধান উপদেষ্টা বেশ কিছু পণ্যে শুল্ক কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পণ্য আমদানি বাড়ানোর কথা বলেছেন। অশুল্ক বাধা দূর করার কথা বলেছেন। অন্য দেশগুলোও নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রেসপন্স করবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, জাতীয পর্যায়ের স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে একটি কমিটি করে আগাম প্রস্তুতি রাখা। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা কী করবো তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা।’
এই তিন মাসকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটার পরিকল্পনা খুব জরুরি বলে মনে করেন এফবিসিসিআই’র সাবেক পরিচালক আবুল কাশেম খান। তার কথা, ‘আমাদের এখন একটা টাইমলাইন করা দরকার। প্রথম এক মাসে কী করবো। তার পরে কী করবো। সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটা এখন দৃশ্যমান করতে হবে।’
‘ওদের মূল টার্গেট হলো বাণিজ্যঘাটতি কমানো। ফলে, তারা একটা বিচিত্র পদ্ধতিতে হিসাব করে শুল্ক আরোপ করেছে। এখন তারা সেটা অর্জন করতে চাইবে। তাদের ওপরও চাপ সৃষ্টি হবে। তাই আমরা বলেছি, সরকারকে এখন একটা টাস্কফোর্স করতে হবে। তার মাধ্যমে একটা কৌশল ঠিক করা যে কোন কোন সেক্টরে আমরা ইউএস পণ্যের আমদানি বাড়াতে পারি, আমাদের আরো কোন ধরনের পণ্যের রফতানি বাড়াতে পরি। কৌশলটা এমন হবে যে- বাণিজ্যঘাটতি কমানো এবং শুল্কের ক্ষেত্রে সমতা নিয়ে আসা। যেমন, আমরা তুলা আমদানি করি। এটা শিল্পের কাঁচামাল। এটা আমদানি বাড়িয়ে আমরা সুবিধা নিতে পারি।’
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এই পরিস্থিতি কতদিন থাকে, তা বলা যায় না। কিন্তু এটা অতি লোভের জন্ম দিতে পারে। চীনে তৈরি পণ্য আমদানি করে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির প্রবণতা বাড়তে পারে। এটা অন্য তৃতীয় দেশও করতে পারে। কিন্তু এটা হলে তা হবে ভয়াবহ। কারণ, সেটা ধরা পড়লে আমরা বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারি। তবে চীনের বিনিয়োগ এখানে আসলে সেই সমস্যা নেই। তখন চীনা বিনিয়োগে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশী পণ্য হিসাবেই বিবেচিত হবে। তবে সেটার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা দেখতে চাইবে সবাই।’
‘তিন মাসে আসলে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ৭৫টা দেশ যেন শুল্ক নীতির পরিবর্তন করে। তারা আবার প্রত্যেকটা দেশের সাথে আলাদা আলাদা বসতে চায়। তিন মাসে একটা সিদ্ধান্তে তারা যাবে। কিন্তু কিভাবে যাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। মেক্সিকো এবং কানাডার সাথে বাণিজ্য চুক্তি করতে করতে কয়েক বছর লেগেছে অ্যামেরিকার,’ বলেন তিনি।
এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই বিকল্প খুঁজবে। এটাও আবার বিশ্ব বণিজ্যে নতুন পরিস্থিতি, সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
ড. মাহফুজ কবির বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই বাণিজ্য নিয়ে কথা বলার জন্য বাংলাদেশের টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট) আছে। সেটাকে আমরা এখন কাজে লাগাতে পারি। খুব অল্প কিছু দেশের সাথেই যুক্তরাষ্ট্রের এই চুক্তি আছে। এই তিন মাসে টিকফাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে।’
আর বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল মনে করেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি সমঝোতা তিন মাসে হলেও সেটা কেমন হবে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সাথে তাতে বাংলাদেশের সমতা থাকবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তাই আমাদের বিকল্প বাজারও খুঁজতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের তৈরি পোশাক রফতানি এখনো বাড়ছে। কিন্তু শুধু সেটার ওপর আমাদের নির্ভর করে থাকলে চলবে না।’