ট্রাম্প ‘আবর্জনা’ ফেলার বদলে মন্ত্রিসভায় নিচ্ছেন
নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি ওয়াশিংটনের আবর্জনা সরাবেন। দ্রব্যমূল্য হ্রাস থেকে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ—সবই ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিনেই অর্জন করবেন। লাখ লাখ বৈধ কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীকে দেশছাড়া করবেন, সে কাজও প্রথম দিন থেকেই শুরু করার কথা। এর মধ্যে কটিতে তিনি সক্ষম হবেন, বলা কঠিন। তবে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, ভোগ্যপণ্যের দাম কমানো সম্ভব হবে না। জিনিসপত্রের দাম একবার বাড়লে তা কমানো কঠিন—টাইম ম্যাগাজিনকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন।
ওয়াশিংটনের আবর্জনা সরানোর যে প্রতিশ্রুতি, তা রাখাও তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে যাঁদের নাম ঘোষণা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশের প্রধান পরিচয় দক্ষ প্রশাসক হিসেবে নয়, বিলিয়নিয়ার হিসেবে। কেউ কেউ আবার তাঁরই মতো নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত। একাধিক ভাষ্যকার বলেছেন, ক্যাবিনেটের নামে ট্রাম্প সার্কাসের ক্লাউনদের জড়ো করছেন। এক হিসেবে বলা হচ্ছে, সিনেট কর্তৃক অনুমোদন পেলে ট্রাম্পের আগামী মন্ত্রিসভায় কম করে হলেও জন পনেরো বিলিয়নিয়ার বা মাল্টি বিলিয়নিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবেন। এঁদের মধ্যে এক ইলন মাস্কের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার।
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সাধারণ আমেরিকানদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো হবে তাঁর প্রধান দায়িত্ব। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সাধারণ আমেরিকানের জীবনযাত্রা সঙ্গে সম্পর্কহীন এসব বিলিয়নিয়ারের পক্ষে কীভাবে ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি পূরণ সম্ভব হবে। ইলন মাস্ক—যাঁকে ট্রাম্প তথাকথিত ‘সরকারি দক্ষতাবিষয়ক দপ্তরে’র দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন, তিনি ব্যয় সংকোচনের নামে মার্কিন বাজেট থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলার ছেঁটে বাদ দেওয়ার আগাম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কাজটা মুখে বলা যত সহজ, কাজে ততটা নয়। মার্কিন বাজেটের তিন-চতুর্থাংশ এমন সব খাতে বরাদ্দ করা যে তার কোনোটিতে হাত দেওয়া অসম্ভব। যেমন প্রতিরক্ষা, মেডিকেয়ার ও সামাজিক নিরাপত্তা। ট্রাম্প নিজেও এসবের কোনোটিতে হাত দেওয়ার বিপক্ষে। তাহলে কাটছাঁট করার বাকি যে খাতগুলো থাকে, তা হলো অতিদরিদ্রদের জন্য ফুড স্টাম্প ও বেকার ভাতা, শিশু পরিচর্যা, শিক্ষা ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ। দ্য নিউ রিপাবলিক পত্রিকা বলেছে, ইলন মাস্কের প্রস্তাব বাস্তবায়নের অর্থ হবে ‘দেশের দরিদ্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’।
অতি সফল এসব ব্যবসায়ীর হাতে নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার অন্য সমস্যা নীতির চেয়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি। একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। ইলন মাস্ক সুপরিচিত তাঁর চালকবিহীন টেসলা গাড়ির জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর এই গাড়ি বিপুলসংখ্যক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সরকারি তদন্তের মুখোমুখি হয়েছে। এই জাতীয় দুর্ঘটনার প্রতিটি নথিবদ্ধ করার যে নিয়ম আছে, ইলন মাস্ক সেটি বদলাতে চান। যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে, সরকার এখন এত সব বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে যে তা সুবিধার চেয়ে অসুবিধার কারণ হয়ে উঠেছে। এই নিয়ম বাদ দিলে মাস্কের লাভ হলেও বিপদে পড়বেন ভোক্তারা।
ট্রাম্প বলেছেন, সরকারি দক্ষতা বাড়াতে তিনি বর্তমানে যেসব বিধিনিষেধ রয়েছে, তার অনেকগুলো কাটছাঁট করবেন। অতিধনীরা যাতে যা খুশি তা করতে না পারেন, সে জন্যই আর্থিক ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ, বাজারের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এসব নিয়মকানুন চালু রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ঠেকাতে ওবামা আমলে যে কনজ্যুমার প্রোটেকশন ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ট্রাম্প তা বাদ দিতে চান। তাঁর প্রথম প্রশাসনে ট্রাম্প প্রায় ১০০ পরিবেশসংক্রান্ত নিয়মকানুন বাতিল করেছিলেন। অনেকে ভয় পাচ্ছেন, বর্তমানে সুপেয় পানি বা বাতাস দূষণ রোধের নানা নিয়মকানুনও তিনি বদলে দেবেন। সবচেয়ে ভয় তেল ও গ্যাস আহরণ নিয়ে। জলবায়ু সংকটের একটি প্রধান কারণ বেপরোয়া তেল-গ্যাস আহরণ। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকেই তিনি তেল-গ্যাস আহরণে চলতি সব বাধা তুলে দেবেন।
স্বজনপ্রীতি
ট্রাম্প তাঁর প্রস্তাবিত ক্যাবিনেটে যাঁদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের বিপুল ধনসম্পদের বাইরে অন্য যে গুণাবলির জন্য মনোনীত হয়েছেন, তা হলো ফক্স নিউজে তাঁদের ঘন ঘন উপস্থিতি অথবা ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়তা। উদাহরণ হিসেবে প্রতিরক্ষা বিভাগের জন্য মনোনীত পিট হেগসেথের কথা বলা যায়। সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্য হলেও হেগসেথের প্রতিরক্ষার মতো বিশাল দপ্তর ব্যবস্থাপনার কোনো অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা নেই, সে কথা উল্লেখ করে ডেমোক্র্যাট সিনেটর ট্যামি ডাকওয়ার্থ বলেছেন, এই লোকের হাতে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া মানে বিপর্যয় ডেকে আনা। একাধিক নারীঘটিত কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও ট্রাম্প যে হেগসেথকেই এই বিভাগের দায়িত্ব দিতে চান, অনেকের মতে তা ফক্স নিউজে ট্রাম্পের পক্ষে তাঁর ঘন ঘন সাফাই। অন্য কারণ, লোকটি সুদর্শন।
ট্রাম্প তাঁর প্রশাসনে এমন অনেককে ডেকে আনছেন, যাঁরা তাঁর নিকটাত্মীয়। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ট্রাম্প জুনিয়রের সাবেক বাগ্দত্তা কিমবারলি গুইলফয়েলকে নির্বাচন করেছেন গ্রিসের রাষ্ট্রদূত হিসেবে। কনিষ্ঠ পুত্র এরিকের স্ত্রী লারা ট্রাম্পের জন্য চাইছেন ফ্লোরিডার একটি সিনেট আসন। কনিষ্ঠ কন্যা টিফানির শ্বশুরকে নির্বাচন করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে, যার একমাত্র প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা হলো তিনি লেবানন থেকে এসেছেন। এই ভদ্রলোক দাবি করেছিলেন, তিনি বিলিয়নিয়ার, কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, না, তিনি নাইজেরিয়ার এক ট্রাক কোম্পানির বেতনভুক্ত কর্মচারীমাত্র।
তবে সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কার শ্বশুর চার্লস কুশনার। ট্রাম্প তাঁকে ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত করতে চান। ২০০৫ সালে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে তিনি দুই বছর জেল খাটেন। সে মামলায় সরকারি সাক্ষী ছিলেন চার্লস কুশনারের ভগ্নিপতি। তাঁকে ফাঁসানোর জন্য চার্লস এক যৌনকর্মীকে হোটেল কক্ষে পাঠিয়ে সেই ঘটনার ভিডিও নিজ বোনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এতে হয়তো সাক্ষ্য দেওয়া থেকে ভগ্নিপতিকে বিরত রাখা যাবে। কিন্তু কোনো কাজে লাগেনি, বিচারে তাঁর দুই বছরের সাজা হয়। পরে ট্রাম্প তাঁকে নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করে ক্ষমা প্রদর্শন করেন। এখন সেই দাগি আসামিই হতে যাচ্ছেন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত।