ট্রাম্প আমলের বাণিজ্য যুদ্ধ খাদের কিনারে নেবে চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি
এতে চীন ও ইউরো অঞ্চলের জন্য অশনি সংকেত থাকলেও – মার্কিন শুল্কের প্রভাব ও মোকাবিলার সক্ষমতায় ভিন্নতাও থাকবে।
২০২৪ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মুক্ত ও অবাধ বিশ্ববাণিজ্যের ধারায় বিশ্বাসী নন ট্রাম্প, যেখানে পুরো বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি বিপুল। বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদী হিসেবে পরিচিত ট্রাম্প- তাঁর প্রথম মেয়াদে এক বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন ইউরোপ এবং বিশেষত চীনের সাথে। ফলে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদকে সামনে রেখে বৃহৎ তিন অর্থনীতির নতুন সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এতে চীন ও ইউরো অঞ্চলের জন্য অশনি সংকেত থাকলেও – মার্কিন শুল্কের প্রভাব ও মোকাবিলার সক্ষমতায় ভিন্নতাও থাকবে।
ইউরোজোনকে পুরোপুরি মন্দার মধ্যে ফেলতে পারে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ
বিনিয়োগ ব্যাংক আইএনজি জানিয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপ থেকে আমদানিতে নতুন করে শুল্কারোপের পথে হাঁটলে – ইউরোজোনে অর্থনীতির বর্তমানে যে ধীর প্রবৃদ্ধির ধারা তা-ও হারিয়ে যাবে, পড়বে পূর্ণদ্যমে মন্দার কবলে।
আগামী জানুয়ারিতে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত নয়, এমন সব পণ্যে ১০ শতাংশ শুল্কারোপ করতে চান বলে জানিয়েছিলেন। আইএনজির বিশ্লেষণ হলো– জানুয়ারির আগেই ইউরোজোনে মন্দা শুরু হয়ে যেতে পারে।
বিনিয়োগ ব্যাংকটি জানায়, জার্মান অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি অর্জনে হিমশিম খাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে ইউরোপের শিল্প জায়ান্ট। শুল্কারোপের ফলে জার্মানির অটোমোবাইল বা গাড়ি রপ্তানি শিল্পের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসবে। এছাড়া, অস্ত্র উৎপাদনের দিকেও জোর দিয়েছে জার্মান উৎপাদকরা। বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তার যে নীতি নেয়, তাঁর আওতায় জার্মানিসহ ইউরোপের অস্ত্র উৎপাদকদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, ইউক্রেনের বিষয়ে ভিন্ন মত রয়েছে ট্রাম্পের, এবং এই নীতির আমূল পরিবর্তন হতে পারে তাঁর আমলে। ন্যাটো সামরিক জোটকে দৃঢ় করার বিষয়েও উদ্যোগী বাইডেন প্রশাসন। এসব পদক্ষেপ ইউরোপে যে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা তৈরি করতে সমর্থন দিয়েছে, তার অবনতি হতে পারে ট্রাম্পের সময়ে।
তবে ২০২৫ সালের শেষদিকের আগপর্যন্ত ইউরোপ শুল্কের কবলে পড়বে না বলে মনে করছে আইএনজি। তারপরেও নতুন বাণিজ্য যুদ্ধের শঙ্কায় অর্থনীতির সূচকগুলোর অবনতি ও বিনিয়োগকারীদের আস্থার ক্ষয় ঘটবে। একারণে এবছর শেষ হতে না হতেই মন্দা শুরু হয়ে যেতে পারে ইউরোপে।
শুল্ক হুমকির মুখে কমানো হচ্ছে ইউরোজোনের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস
বিনিয়োগকারী ও অর্থনীতিবিদরা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপীয় রপ্তানি পণ্যে ভারি শুল্কারোপের আশঙ্কায় প্রমাদ গুনছেন।
জার্মানির হামবুর্গ-ভিত্তিক ব্রিহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যারেনবার্গ ব্যাংক হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রবেশ ইউরোপীয় ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য ‘ব্যাপকমাত্রায় বাণিজ্য নীতিসংক্রান্ত ও ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার’ ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইউরো অঞ্চলের সবচেয়ে বিকশিত অর্থনীতি জার্মানিতে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। গতকাল বুধবার জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ অপ্রত্যাশিতভাবে পদচ্যুত করেন দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রীকে। এতে ভেঙে পড়েছে জোট সরকার। রাজনৈতিক এই অনিশ্চয়তা ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে বার্লিনের জন্য।
ব্যারেনবার্গের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হোলগার স্মিডিং বলেছেন, আমরাদের ধারণা ট্রাম্প শুরুর দিকে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে শুল্কারোপ করবেন, একইসঙ্গে চীন ও ইউরোপ যদি বাণিজ্য আলোচনায় আরও ছাড় না দেওয়ার প্রস্তাব দেয় – তাহলে আরও বেশি শুল্কারোপের হুমকি দেবেন। ২০১৭- ২০২০ সময়ে যেমনটা তিনি এর আগে করেছেন।
বাণিজ্য নিয়ে এ ধরনের উত্তেজনার জেরে ইউরো অঞ্চলে ২০২৫ সালের প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ কমতে পারে। আর সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জার্মানিতে তা কমতে পারে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। কারণ ব্যবসা ও বিনিয়োগের আস্থায় তখন ফাটল দেখা দেবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চাহিদা এখন বেশ শক্তিশালী, যার সাময়িক সুবিধা নিতে পারবে ইউরোজোনের অর্থনীতিগুলো। ইউরোর তুলনায় মার্কিন ডলার অধিক শক্তিশালী হওয়ার সুবিধাও পাবে কিছু সময়ের জন্য। এর ফলে ইউরোতে নির্ধারিত পণ্যের মূল্য মার্কিন বাজারে আরও প্রতিযোগিতাসক্ষম থাকবে।
ফলে ২০২৫ সালের জন্য ইউরো অঞ্চলের অর্থনীতির পূর্বাভাস মাঝারি হারে কমিয়েছে ব্যারেনবার্গ ব্যাংক। আগামী বছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ১.১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে যা শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, এবং ইতালির ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়েছে।
সে তুলনায় জার্মানির পূর্বাভাস কমানো হয়েছে বেশি। আগামী বছরে তা শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। এর আগে ব্যারেনবার্গ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ দিয়েছিল।
৬০ শতাংশ শুল্কারোপের ঝুঁকি সত্ত্বেও মোকাবিলার প্রস্তুতি ভালোভাবেই নিয়েছেন শি জিনপিং
২০১৮ সালে প্রথম চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, এরজন্য তখন মোটেও প্রস্তুত ছিল না বেইজিং। মুক্তবাণিজ্যের প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই এহেন পদক্ষেপের পাল্টা কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ – তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন নীতিনির্ধারকরা। তবে এবার বাণিজ্য যুদ্ধের জন্য আরও ভালো প্রস্তুতি নিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। যদিও এতে তাঁর দেশের ক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে।
ট্রাম্প চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছেন। ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স বলেছে, এই মাত্রায় শুল্কের বোঝা বিশ্বের বৃহৎ দুই অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্যকে ‘ধ্বংস করবে’। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের পরে জো বাইডেন ক্ষমতায় এসেই উচ্চ প্রযুক্তি পণ্য চীনে রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। আবার চীনের বৈদ্যুতিক যানসহ অন্যান্য পণ্য আমদানিতেও কঠোর হন। এরসাথে ট্রাম্প যদি এত শুল্ক বসান, তাহলে বাণিজ্যে ব্যাপক ধস নামবে এটাই স্বাভাবিক।
তবে ট্রাম্প ক্ষমতার বাইরে থাকার চার বছরে চীন আগের চেয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। যাতে দ্বিতীয় দফার বাণিজ্য সংঘাতের আঘাত আরও সহ্য করতে পারে, এবং এমনকী পাল্টা আঘাত করবার ক্ষেত্রেও ভালো অবস্থানে থাকে। এজন্য সব ধরনের পন্থার কথাও ভেবে রেখেছে, যারমধ্যে অন্যতম হবে যুক্তরাষ্ট্রে বিরল খনিজসহ গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিপণ্য আমদানিতেও শুল্কের বোঝা বাড়ানো এবং তালিকা করে বিভিন্ন আমেরিকান কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
চীনের সামরিক বাহিনী– গণমুক্তি ফৌজের সাবেক কর্নেল এবং শিংগুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজির সিনিয়র ফেলো ঝৌ বো বলেন, “চীন তাঁকে (ট্রাম্পকে) মানসিকভাবে মোকাবিলার জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত।
নির্বাচিত হওয়ায় প্রথা অনুযায়ী ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন শি জিনপিং এবং উভয় দেশের মধ্যে ‘সুষ্ঠু ও টেকসই’ সম্পর্ক বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রস্তুতি নেওয়ার পরেও শি প্রথমে বাণিজ্য যুদ্ধকে এড়িয়ে চলাই পছন্দ করবেন। কারণ দ্বিতীয় বাণিজ্য যুদ্ধের ক্ষতি প্রথমটির চেয়েও ব্যাপক হবে।
আবাসন খাতের ধস, মুদ্রার মান বাড়া, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিমন্থরতাসহ নানাবিধ সংকটে রয়েছে চীন। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে, বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং ব্যাটারি রপ্তানিসহ প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভর করছে। প্রবৃদ্ধিকে চাঙ্গা করতে বিপুল অংকের প্রণোদনা প্যাকেজও দেওয়া হবে অচিরেই। চলতি সপ্তাহে এবিষয়ে বৈঠকও করবেন দেশটির আইনপ্রণেতারা।
কিন্তু, ট্রাম্প যে হারে শুল্কের হুমকি দিয়েছেন, যদি সেটাকে বাস্তবে রূপ দেন– তাহলে চীনের নীতিনির্ধারকদের অর্থনীতিকে সহায়তা দেওয়ার আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। গোলম্যান স্যাক্স গ্রুপ জানিয়েছে, চড়া হারে শুল্কারোপ করা হলে – তখন অভ্যন্তরীণ ভোগ-চাহিদাকে চাঙ্গা করতে চাইবেন শি জিনপিং। প্রথাগতভাবে যেটি না করারই পক্ষপাতী ছিল চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি।
সম্পদ ব্যবস্থাপক, কর্পোরেট ও বিনিয়োগ ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী সংস্থা ন্যাটিসিক্স এসএ’র এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ গার্সিয়া হ্যারেরো বলেন, ‘৬০ শতাংশ শুল্কের বিপরীতে চীনের খুব বেশিকিছু করতে পারবে না। তবে দেশটি আরও বড় প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিতে পারে, যাতে আর্থিক বাজার চীনকে শাস্তি না দেয়।”
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে টানা দুই বছর চলেছে উভয় দেশের পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপ এবং সেইসাথে বাণিজ্য যুদ্ধ অবসানের আলোচনা। যার ভিত্তিতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ২০ হাজার কোটি ডলারের আমেরিকান পণ্য আমদানির মাধ্যমে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। তবে ওই সময়ে করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় – যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ে। ফলে চীন কখনোই প্রতিশ্রুত পরিমাণে আমদানি বাড়াতে পারেনি। চীনে সংক্রমণ দীর্ঘদিন ধরে চলার কারণেও তা করা যায়নি।
এই অবস্থায়, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের নয়া বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্ববাণিজ্যকে মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে ফেলবে। গেল বছর চীনের কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশটির মোট রপ্তানির ১৫ শতাংশ। ওয়াশিংটন যদি এগুলোর ওপর উচ্চ শুল্কারোপ করে – তাহলে এসব পণ্যের বিক্রি ব্যাপক মাত্রায় কমবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে – যখন চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও ধুঁকছে।