ট্রাম্প কি নিজেকে রাজা-বাদশাহ ভাবতে শুরু করেছেন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে ফেরার পর আদতে কী ঘটতে পারে বা ঘটছে, সেটা কখনোই অনুমান করা সম্ভব হয়নি, হবেও না। তিনি কি কোনো বিদেশি নেতাকে ভর্ৎসনা করবেন? বিশ্ববাজারে বড় ঝাঁকি দেবেন, নাকি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কড়া কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেবেন? অনুমান করা বড়ই কঠিন।
তবে ১০০ দিনের বিশৃঙ্খল কার্যকলাপ দেখেশুনে একটি বিষয়ে অনুমান করাই যায়, ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ১০০ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে প্রায় রাজা-বাদশাহর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে ৭৮ বছর বয়সী রিপাবলিকান রাজনীতিক ট্রাম্প বলেন, ‘আমার মনে হয়, দ্বিতীয় মেয়াদটা আরও বেশি শক্তিশালী।’ তিনি যোগ করেন, ‘তাঁরা সব কাজ করে ফেলেন…আমি যখন করতে বলি, তাঁরা করে ফেলেন। তাই নয় কি?’
নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হেরে যাওয়ার পর ২০২১ সালে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল ট্রাম্পকে। ওই সময় ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্প–সমর্থকদের হামলা ও দাঙ্গার মতো লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ট্রাম্পকে বিদায় নিতে হয়েছিল। কার্যত একটি বিশৃঙ্খল মেয়াদ পার করার অভিযোগের অনুভূতি তাড়িত করেছে ট্রাম্পকে।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নেওয়ার প্রথম দিনেই ক্যাপিটলে হামলায় জড়িত কয়েক শ কারাবন্দীকে মুক্তি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ। ওয়াশিংটন ডিসিতে, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ ম্যাট ডালেক এএফপিকে বলেন, ‘ট্রাম্প ২.০ (প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ) তাঁর প্রথম মেয়াদের চেয়ে অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী মনোভাব দেখাচ্ছেন এবং কাজের ক্ষেত্রেও তিনি কর্তৃত্ববাদী।’
ট্রাম্প যেন একটি অন্তহীন রিয়েলিটি শোর অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছেন, যেখানে তিনি নিজেই তারকা। কেননা, ট্রাম্প প্রায় প্রতিদিনই ওভাল অফিসে বিভিন্ন নির্বাহী আদেশে সই করছেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। তাঁর এসব আদেশ মার্কিন গণতন্ত্রের ভিত্তি এবং বিশ্বব্যবস্থার ওপর অভূতপূর্ব আঘাত হেনেছে।
ম্যাট ডালেক বলেন, ‘সাংবিধানিক সুরক্ষা ভেঙে দেওয়ার জন্য আমরা আধুনিক সময়ে এমন ধারাবাহিক আঘাত আগে কখনোই দেখিনি।’
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্কের বিতর্কিত সহায়তায় ট্রাম্প ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ এক অভিযান শুরু করেছেন। এটাকে তিনি উদার ‘ডিপ স্টেট’ বলে মনে করছেন। তিনি অভিবাসীদের এল সালভাদরের একটি বিশাল কারাগারে নির্বাসিত করার জন্য শতাব্দীপ্রাচীন যুদ্ধকালীন আইন প্রয়োগ করেছেন। সতর্ক করেছেন, পরবর্তী পদক্ষেপ মার্কিন নাগরিকদের ওপর হতে পারে।
ট্রাম্প বিচারকদের সঙ্গেও বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আগে যেসব আইনি সংস্থা ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলায় সম্পৃক্ত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে এসেও সংবাদমাধ্যমের ওপর খড়্গহস্ত হয়েছেন ট্রাম্প। তিনি এখনো সংবাদমাধ্যমকে ‘মানুষের শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। হোয়াইট হাউসে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ সীমিত করেছেন।

প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নিয়ে একের পর এক নির্বাহী আদেশ জারি করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
একটি আদর্শিক শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছেন ট্রাম্প। বৈচিত্র্যের কর্মসূচিগুলোয় কাটছাঁট আর প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানানো এর প্রমাণ। সেই সঙ্গে তিনি নিজেকে একটি মর্যাদাপূর্ণ শিল্পকেন্দ্রের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সরকারি অর্থায়নের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ মার্কিন কংগ্রেসকেও পাশ কাটানো হচ্ছে।
ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে রিপাবলিকানদের অনেকেই ট্রাম্পকে প্ররোচনা দিয়ে যাচ্ছেন। আর নিপীড়িত ডেমোক্র্যাটরা এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জড়ো করতে লড়াই করছেন।
‘আমরা সবাই বেশ ভীত হয়ে পড়েছি’—বলছিলেন রিপাবলিকান সিনেটর লিসা মারকৌসকি।
আইওয়ার গ্রিনেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বারবারা ট্রিশ বলেন, প্রেসিডেন্ট তাঁর ক্ষমতার ওপর আনুষ্ঠানিক, এমনকি সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে উদাসীন বলেই মনে হচ্ছে।
বৈশ্বিক মঞ্চেও একাধিক বিষয়ে সাড়া ফেলেছেন ট্রাম্প। যেমন গ্রিনল্যান্ডের ওপর যেকোনো উপায়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা। পানামা খাল ও কানাডার নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছেন ট্রাম্প। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্প্রসারণবাদী প্রবণতার মতো করে একটি প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন ট্রাম্পও।
বারবারা ট্রিশ বলেন, প্রথম মেয়াদের তুলনায় এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এমন কিছু সহযোগী ঘিরে রেখেছেন, যাঁরা শুধু তাঁর ক্ষমতার বিষয়ে নির্লজ্জ গতিবিধিকে সহজ করছেন না, বরং কিছু ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা রাখছেন।
তবে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ফিরে আসা বেশ কিছু পরিচিত বিষয়ের দিকে মনোযোগ কেড়েছে। জরিপকারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ট্রাম্পের মতো আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট মানুষের এতটা কম সমর্থন নিয়ে ক্ষমতার প্রথম তিন মাস পার করেননি। যদিও নিজের প্রথম মেয়াদের শুরুর তিন মাসে ট্রাম্পের প্রতি জনসমর্থন এখনকার চেয়ে কম ছিল।
এটা ইঙ্গিত দেয় যে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্ববাসী যেমন একজন অস্থির নেতা দেখেছিলেন; এবারও তেমনটাই দেখা যেতে পারে।
ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ঘটনা ও রাশিয়ার প্রতি ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেরও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও হতাশা বাড়িয়ে তুলেছে। এরপর ট্রাম্প চীনসহ বিভিন্ন দেশের ওপর বাড়তি আমদানি শুল্ক আরোপ করেছেন। এ ঘটনা বিশ্ববাজারে অস্থিরতা ছড়িয়েছে। ক্ষমতার ওপর তাঁর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ জোরদারের প্রমাণ দিয়েছে।
বাড়তি শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত কীভাবে নিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্পের চটজলদি উত্তর ছিল: সহজাতভাবে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্প কি সহজে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে পারবেন? কেননা, ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প নিজেকে ‘একজন রাজা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই নির্ধারিত সময়ে তাঁর ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন। তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নেই। তবে এক মেয়াদ বিরতি দিয়ে এরপর টানা দুই মেয়াদে কেউ প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে কিছু বলা নেই। তাই হয়তো এ সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবেন ট্রাম্প। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, যখন বারবার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার বিষয়ে তিনি কথা বলছিলেন, তখন তিনি মোটেও ‘মজা করছিলেন’ না।