ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে গুলি, লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা

গভীর রাতে মুহাম্মদ নোমান ভাবলেন, এবার বাঁচার শেষ সুযোগ। তাঁর বগিতে পাহারায় থাকা তিনজন সশস্ত্র লোক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দ্রুত তিনি পালানোর পরিকল্পনা করলেন। “এটি জীবন-মৃত্যুর এক জুয়া…এখনই না হলে আর কখনোই নয়।” তিনি সহযাত্রীদের বোঝালেন।
তারপর ৩০ বছর বয়সী নোমান, আরও এক ডজনেরও বেশি যাত্রীসহ, জাফর এক্সপ্রেস থেকে নেমে আশপাশের পাহাড়ি অঞ্চলে লুকিয়ে পড়েন। পেছনে তখন বিভীষিকা—চারপাশে গুলি চলছিল, আতঙ্কে মানুষ দিকবিদিক ছুটছিল। কিন্তু তাঁরা আর পেছনে তাকাননি। “আমরা চার ঘণ্টা ধরে হাঁটলাম এবং কেবল তখনই থামলাম, যখন ফ্রন্টিয়ার কর্পসের একটি চেকপয়েন্টে পৌঁছালাম,” বলেন নোমান।
জিম্মি হওয়া থেকে বাঁচার লড়াই
বেলুচিস্তানে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কবল থেকে কৌশলে বেঁচে ফেরা নোমান গণমাধ্যমের কাছে সেই বিভীষিকাময় রাতের বর্ণনা দিয়েছেন। গত ১১ মার্চ, নিষিদ্ধ ঘোষিত বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) সন্ত্রাসীরা কোয়েটা থেকে প্রায় ১৫৭ কিলোমিটার দূরে মাশকাফ টানেলের কাছে জাফর এক্সপ্রেসে হামলা চালিয়ে প্রায় ৪৪০ জন যাত্রীকে জিম্মি করে।
এর আগে বিদ্রোহীরা রেললাইনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও, পুরো ট্রেন ও যাত্রীদের জিম্মি করার ঘটনা এটিই প্রথম।
সেনাবাহিনীর অভিযান ও ভয়াবহ মৃত্যু
পরবর্তীতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী উদ্ধার অভিযান শুরু করে, যা গত বুধবার রাতে শেষ হয়। সেনাবাহিনীর গণমাধ্যম শাখার এক বিবৃতিতে বলা হয়, “অভিযানে ৩৩ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে এবং সমস্ত যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে।”
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী জানান, “সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফ্রন্টিয়ার কর্পস (এফসি) এবং স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এসএসজি) এই অভিযানে অংশ নেয়।” তিনি আরও জানান, “উদ্ধার অভিযানের আগে ২১ জন যাত্রী নিহত হন এবং এফসির চার সদস্য প্রাণ হারান।”
সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা
নোমান ছিলেন সেই ভাগ্যবানদের একজন, যিনি প্রাণে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর বেশিরভাগ বন্ধুর সেই সৌভাগ্য হয়নি। “আমরা প্রায় ২০ জন আফগানিস্তানে কাজ করছিলাম। কয়েক সপ্তাহের জন্য আমরা গুজরানওয়ালা ও লাহোরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,” বলেন তিনি।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তাঁদের মধ্যে মাত্র তিনজন জীবিত ছিলেন—অন্যরা হয় নিহত হয়েছেন অথবা এখনো নিখোঁজ।
সন্ত্রাসীদের বীভৎস নির্যাতনের বিবরণ
নোমানের চোখের সামনে তাঁর সহযাত্রীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তিনি বলেন, “ট্রেন থামার পরপরই গুলি শুরু হয়। অস্ত্রধারীরা বগির ভেতরে ঢুকে যাত্রীদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করতে থাকে।”
আরেক যাত্রী মুহাম্মদ নবীদ বলেন, “সন্ত্রাসীরা আমাদের একে একে ট্রেন থেকে নামতে বলে। নারীদের আলাদা করে ছেড়ে দেয়, বয়স্কদেরও যেতে দেয়। কিন্তু পুরুষদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “১৮৫ জনকে বাইরে এনে বলা হয়, ‘তোমাদের কিছু করা হবে না।’ কিন্তু এরপরই তারা নির্বিচারে গুলি চালায়।”
আরেক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য
আরসালান ইউসুফ বলেন, “তাদের কাছে রকেট লঞ্চার, বন্দুকসহ বিভিন্ন অস্ত্র ছিল। তারা আমাদের অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে নেয়।”
“তারা সৈন্যদের ধরে নিয়ে সরাসরি হত্যা করত। ট্রেনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর শতাধিক সদস্য ছিলেন। যদি কারও প্রতি তাদের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থাকত, তাহলে তারা সরাসরি গুলি চালাত,” বলেন তিনি।
“আমি কেয়ামতকে কাছ থেকে দেখেছি”
৭৫ বছর বয়সী মুহাম্মদ আশরাফ, যিনি লাহোর যাচ্ছিলেন, জানান, “আমি কেয়ামত ও মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, কিন্তু আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন।”
তিনি বলেন, “এক ঘণ্টার মধ্যেই অন্তত ১০ জনকে হত্যা করা হয়, যাদের মধ্যে তিনজন রেলওয়ে পুলিশ ও তিনজন পুলিশ কমান্ডো ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তাদের অস্ত্রও ছিনিয়ে নেয়।”
কর্তৃপক্ষের নীরবতায় ক্ষোভ
কোয়েটা রেলওয়ে স্টেশন ছিল প্রিয়জনদের ফেরার অপেক্ষায় থাকা পরিবারের ভিড়ে ঠাসা। ৩০ বছর বয়সী আব্দুল রউফ বারবার রেললাইনের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, “আমি মঙ্গলবার বাবাকে বিদায় জানিয়েছিলাম… কিন্তু এখনো তাঁর কোনো খোঁজ নেই।”
রউফ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “কর্তৃপক্ষ কোথায়? কে আমাদের কথা শুনবে? আমরা সারা জীবন এই দেশের জন্য কাজ করেছি, তাহলে আমাদের সঙ্গে এমন কেন হচ্ছে?”