ডলার সংকট আরো তীব্র, আশা জোগাচ্ছে রেমিট্যান্স
বৈদেশিক বাণিজ্যেও পড়েছে দেশজুড়ে চলা অস্থিরতার প্রভাব। দীর্ঘদিন ধরে চলা ডলার সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে নতুন করে ঋণপত্র (এলসি) খোলা প্রায় বন্ধ। আমদানিকারকরা ডলার সংকটে পুরনো বকেয়া পরিশোধেও হিমশিম খাচ্ছেন।
ব্যাংকের পাশাপাশি খোলাবাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না মার্কিন এই মুদ্রা। তবে ডলার সংকট নিরসনে আশার আলো দেখাচ্ছে রেমিট্যান্সপ্রবাহ।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে দেশে অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছে। এর প্রভাবে দুর্বল অর্থনীতি আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
যেকোনো মূল্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া জরুরি। না হলে দেশজুড়ে অস্থিতরা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ছয় হাজার ৭৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছয় হাজার ৯৯৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়।
এক বছরের ব্যবধানে আমদানি কমেছে ১৩.১৯ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক গড়ে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে তার ওপরেও ঋণপত্র খোলা (এলসি) হতো। কোনো কোনো দিন এক হাজার মিলিয়ন বা এক বিলিয়ন ডলারের এলসি হতেও দেখা গেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে শুরু হওয়া অস্থিরতায় ব্যাপক হারে কমতে শুরু করে এলসি খোলার পরিমাণ। চলতি আগস্ট মাসের ১ তারিখে ব্যবসায়ীরা এলসি করেছিলেন ৬২৩ মিলিয়ন ডলারের।
এরপর দুই দিন ছিল ছুটি। ৪ আগস্ট ১৯১ মিলিয়ন, ৬ আগস্ট ১৬৪ মিলিয়ন এবং ৭ আগস্ট ১৬৭ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়। এ পরিস্থিতিই প্রমাণ করে ব্যবসায়ীরা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী নন। আর্থিক খাত সংস্কারের আশায় ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জানান, নতুন এলসি খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। কারণ ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। যেসব রপ্তানিকারকের ডলার অ্যাকাউন্টে জমা আছে, বর্তমানে শুধু তাঁরাই আমদানির দায় পরিশোধ করতে পারছেন। এর বাইরে যাঁরা ব্যাংক থেকে ডলার কিনে আমদানি বিল পরিশোধের চিন্তা করছেন, তাঁরা সবাই ফিরে যাচ্ছেন। কারণ বেশির ভাগ ব্যাংকের কাছে ডলার জমা নেই। আবার যাঁদের কাছে আছে তাঁরা ভবিষ্যৎ আমদানি পেমেন্টের কথা চিন্তা করে ডলার খরচ করছেন না।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। চলমান পরিস্থিতিতে সমস্যা তো হচ্ছেই। ক্ষমতায় যেহেতু নতুন সরকার এসেছে, আমার মতে দেশটাকে ঘুরে দাঁড় করানোর জন্য তাদের কিছুটা সময় দেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে নতুন এলসি খোলা বন্ধ রয়েছে বললেই চলে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ব্যবসা করা কঠিন। এ কারণে নতুন করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শঙ্কায় আছেন ব্যবসায়ীরা। আমদানির বকেয়া বিল পরিশোধ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ ডলার সংকট পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। নতুন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, ব্যবসায়ীদের যেন ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। বৈদেশিক বাণিজ্য যেন কোনোভাবে ব্যাহত না হয়।’
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে এলসি খোলার চিন্তাই করা যাচ্ছে না। আমদানির পুরনো বিল পেমেন্টে ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে সবার আগে প্রয়োজন দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা।’
রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মার্কেট, দিলকুশা ও ফকিরাপুল এলাকার মানি এক্সচেঞ্জগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বেশির ভাগ সাইন বোর্ডে ডলারের দাম লেখা আছে ক্রয়-১১৮.৫ এবং বিক্রয় ১১৯.৫০ টাকা। কিন্তু কোনো এক্সচেঞ্জ হাউসেই ডলার নেই। ক্রেতা সেজে একটি এক্সচেঞ্জ হাউসে গেলে গোপনে তারা ১২১ টাকায় ডলার দিতে রাজি হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম জামান বলেন, ‘খোলাবাজারে ডলার বেচাকেনার অবস্থা খুবই খারাপ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যত দিন স্বাভাবিক না হচ্ছে, তত দিন এ রকম অবস্থাই থাকবে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন রেমিট্যান্স পাঠানো একেবারে বন্ধ ছিল। বিদেশে যাতায়াতও কম। এসব কারণে খোলাবাজারে ডলারের সরবরাহ নেই বললেই চলে। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ আবার বাড়ায় শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সরকার পতনের পর থেকে দেশে বৈধপথে রেমিট্যান্স আসার গতি বাড়তে শুরু করেছে। আগস্টের প্রথম ১০ দিনে দেশে বৈধপথে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ৪৮ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। জুলাই মাসে দেশে ১৯০ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে রেমিট্যান্স কমে ৬৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। জুন মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ মে ডলারের দাম ও ঋণের সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পালনের অংশ হিসেবে ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে এক লাফে সাত টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ব্যাংক ও খোলাবাজারে। ফলে এলসি খোলার ক্ষেত্রে ১২০ টাকা এবং খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২৫ টাকা ছাড়িয়ে যায়। সেই দাম কমে বর্তমানে আবার ১২০ টাকার আশপাশে ঘোরাফেরা করছে।