ডাকসু নির্বাচন, আওয়ামী লীগের অট্টহাসি

ডাকসুর ফলাফলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ তাজ্জব হয়েছেন। আবার অনেকেই খুশি। তারা বলছেন, ফলাফল এমনটাই আশা করা গিয়েছিল। কারণ বুদ্ধির খেলায় অপরপক্ষ ধরাশায়ী হয়েছে। এখানে আপনি সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ আনতে পারেন। বলতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়। এ কারণে জালিয়াতি হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি ধোপে টিকবে না। কারণ এর বিকল্প কোনো রাজনীতি আপনি হাজির করতে পারেননি। গতানুগতিক রাজনীতির মধ্যেই আপনি সমাধান খুঁজেছেন। যেটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে আসলেই বেমানান। যুক্তি এখানে অচল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আলোড়িত হচ্ছে। সিদ্ধান্ত বদল করছে প্রতি মূহূর্তে। আবেগের কাছে মানুষ নিজেকে সঁপে দিচ্ছে। বাছ-বিচার এখানে অনুপস্থিত।
ডাকসু নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ারিং যে হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সময় যত গড়াচ্ছে ততই নানা খবর আসছে। একজন নারী ভোটার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলছেন, তিনি বাকের মজুমদারকে ভোট দিয়েছেন। অথচ গণনার সময় দেখা গেল তিনি পেয়েছেন শূন্য ভোট। এটা কী করে সম্ভব! তাহলে কি ভোট গণনায় ইভিএম-এর ছায়া রয়েছে! যাইহোক, নব্বই দশকের রাজনীতি দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লড়াই করা যে সম্ভব নয়, সেটা বোঝার সক্ষমতা অপরপক্ষের মধ্যে ছিলই না। ছাত্রশিবির আর ছাত্রদলের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ছাত্রশিবির মুহূর্তের মধ্যে কৌশল বদলাতে পারে। ভয়ঙ্কর এক কৌশল গ্রহণ করেছিল তারা আওয়ামী জমানায়। শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে তারা অবিশ্বাস্য কৌশল গ্রহণ করেছিল। তারা ঢুকে পড়েছিল ছাত্রলীগের মূলস্রোতে। এটা ছিল দলীয় সিদ্ধান্তে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে যারা মূল নেতৃত্বে এসেছে তাদের সবার ইতিহাস এখন জানা।

অনেকেই শিবির থেকে ছাত্রলীগে আবার ছাত্রলীগ থেকে শিবিরে ফিরেছেন। হাসিনার ১৬ বছরের শাসনে ছাত্রদলের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। না ছিল কমিটি, না ছিল বিচ্ছিন্ন অবস্থান। শুধু ঝটিকা মিছিল দিয়েই জানান দেয়া হয়েছিল- আমরা আছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদলের কোনো নাম-নিশানাই ছিল না। শেখ হাসিনা জাতীয়তাবাদী শক্তিকেই মূল টার্গেটে পরিণত করেছিলেন। এটাতো স্পষ্ট যে, ২০২৩ সনের ২৮শে অক্টোবর বিএনপির বিশাল জনসভা ভেঙে দিল হাসিনার প্রশাসন। কিন্তু একই দিনে র্যাব পাহারায় অনুষ্ঠিত হয় জামায়াতের জনসভা। এতকিছুর পরও বিএনপি নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে তাদের রাজনীতি সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। পরিণতিতে এখন সামন্যতম কৌশলের কাছেই হেরে যাচ্ছেন। ঘর রয়েছে অগোছালো। অথচ বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে চাচ্ছেন পুরনো মারপ্যাঁচে। এটা যে হবার নয়, তা তো ডাকসুতে দেখা গেল।

বলাবলি হচ্ছে- ছাত্রলীগের ভোট কারা পেল। অনেকেই বলছেন, সহজ হিসাব। শিবিরকেই তারা ভোট দিয়েছেন তাদের নতুন ন্যারেটিভে। তারা দেখাতে চান দুনিয়াকে- আমাদের পতনের পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, তাহলে যে জগন্নাথ হলে আমরা অন্য চিত্র দেখলাম। জগন্নাথ হল আর আওয়ামী লীগের রাজনীতির কৌশল তো এক নয়। জগন্নাথ হলে সচেতন ছাত্ররা এই যুক্তির কাছে আদর্শ বিলিয়ে দেয়নি । শিবিরের ভোটকৌশল প্রশংসার দাবি রাখে। তারা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছে। নানাভাবে অভিভাবকদেরকেও তর্কে পরাভূত করার হাজারও যুক্তি দেখিয়েছে। তারা অনেকখানি সফল হয়েছে।

৫ই আগস্টের পর বিএনপির আচরণে অনেক অভিভাবক বিক্ষুব্ধ। এর প্রতিফলন দেখা গেছে ভোটের বাক্সে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মোটেই নিরপেক্ষ ছিল না। তারা কখনো লম্বা ছুটি দিয়েছে ভোটের আগে। সমালোচনার মুখে আবার ছুটি বাতিলও করেছে। এটা ছিল তাদের কৌশলের অংশ। রক্তের গ্রুপ দেখে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। কিছু ব্যতিক্রমও দেখা যায়। পর্দার আড়ালের রাজনীতির খেলাও এখানে অনেকটাই স্পষ্ট ।

প্রশ্ন উঠতেই পারে- নির্বাচন নিয়ে পর্দার আড়ালে অনেক আগেই কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল? যার সূক্ষ্ণ বাস্তবায়ন দেখা গেল ভোটের দিন! ছাত্রদলের কোনো সাংগঠনিক ভিত্তিই ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় রাজনীতির আবহ দিয়ে বাজিমাত করা যে সম্ভব নয়- এটা বোধকরি বিএনপি নেতারা এখন বুঝতে পারছেন। এর মধ্যে নিজেদের ভেতরে কোন্দল এতটাই প্রবল ছিল যে, প্রকাশ্যে কেউ কেউ ক্যাম্পেইন চালিয়েছেন। নানা সমালোচনা ছিল তাদের মুখে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক মুখ্য ভূমিকা রেখেছে এই নির্বাচনে।

এর পেছনে শিবির অভিভাবকদের ছিল হাতখোলা। এমনকি প্রিন্ট মিডিয়াতেও দেখা গেল একতরফা প্রচারণা। যারা একদিন জামায়াত-শিবিরের নামই শুনতে পারতেন না – তাদের আচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে হাজারও বিতর্ক হতে পারে। বিদেশে বসে আওয়ামী লীগের নেতারা অট্টহাসি হাসতে পারেন। ঢাকায় সুশীলরা নানা যুক্তি দেখাতে পারেন। কিন্তু দিনের শেষে ঘটনা ঘটে গেছে। সামনে বিপদের ঘনঘটা। কেন জানি মনে হয়, যারা নির্বাচনের গায়ে রাজাকার তত্ত্ব যুক্ত করেছিলেন তাদের হিসাব ছিল ভুল। বর্তমান বাংলাদেশকে তারা চিনতেই পারেননি।