ডাকাত আতঙ্ক সর্বত্রই

৭ মাসেও মানুষ স্বাভাবিক জীবন পায়নি নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি না হওয়া ও বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় ছিনতাই-ডাকাতির মতো অপরাধ বেড়ে গেছে অন্যের ওপর দায় চাপানোর সংস্কৃতি চর্চার বদলে অন্তর্বর্তী সরকারকে বাস্তববাদী দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে হবে
‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’ (মদনমোহন তর্কালঙ্কার)। কবির ‘আমার পণ’ কবিতার মতোই মানুষের পণ হয়েছে ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/রাস্তায় চলতে-ফিরতে যেন ডাকাতের কবলে না পড়ি।’ মানুষ কোথাও স্বস্তি পাচ্ছে না। হাট-বাজার-পথঘাট-যানবাহন কোথাও নিরাপত্তা নেই। সর্বত্রই ছিনতাই-ডাকাতির ভীতি আতঙ্ক। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়েছে সাত মাস আগে। তার অলিগার্ক চোর ছেচ্চর, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ, লুটেরারা লাপাত্তা। দিল্লির সেবাদাসী হাসিনা পালানোয় মানুষ খুশি। কিন্তু প্রাত্যহিক যাপিত জীবনে স্বস্তি আসেনি। অর্থনৈতিকভাবে অস্বস্তি, বেকারত্বের যন্ত্রণা কমেনি; বরং অনেকগুলো শিল্পকারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সে হারে আয় বাড়েনি, অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে বিদেশি বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনাও নেই; বিদেশে টাকা পাচারকারী পলাতক হাসিনাসহ তার অলিগার্কদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখির দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। ফলে ত্যাগের মহিমায় যে স্পিরিট নিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মানুষ রাজপথে নেমে পড়েছিল ক্রমান্বয়ে তা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে নতুন যন্ত্রণা হিসেবে দেখা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। কিছুদিন ধরে দিনে-রাতে ডাকাতি যেন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। শত শত মানুষের সামনেই জিম্মিদশা সৃষ্টি করে ডাকাতরা সব কিছু লুটে নিয়ে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি কার্যত ওপেন সিক্রেট। অর্থনীতিবিদ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা উচ্চশিক্ষিত বেকাররা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ! বেকারত্বের কারণে অনেকে অপরাধমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ছে।
পরিবেশ স্বাভাবিকীকরণের প্রয়োজনে অন্যের ওপর দায় চাপানোর সংস্কৃতি চর্চার বদলে আন্তর্বর্তী সরকারকে বাস্তববাদী দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, বেকারত্বের কারণে অনেকে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। দেশে যখন চাহিদামতো চাকরি বা উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ না থাকে, তখন মানুষ বেঁচে থাকার প্রশ্নে যার আছে, তার থেকে ছিনিয়ে নেয়, অপরাধমূলক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে বা তার সম্পদ দখল করে সে নিজে ভালো থাকার এ ধরনের চেষ্টা করে। এটি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। এখান থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন কর্মক্ষম ব্যক্তিকে কাজের সুযোগ করে দেয়া। বেকারত্ব দূরীকরণে ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে বেকারদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে থাকবে।
সড়ক মহাসড়কে ডাকাতি ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। দেশি অস্ত্রের পাশাপাশি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ডাকাতরা যাত্রীদের জানমালের ক্ষতি করছে। রাজধানীর আবাসিক এলাকা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সড়কে একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশে নতুন করে কর্মসংস্থারের সৃষ্টি না হওয়া, অর্থনৈতিক দুর্দশা, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের কারণে ডাকাতিসহ নানা অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তবে পতিত আওয়ামী সরকারের একটি চক্র দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে পরিকল্পিতভাবে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিশোর তরুণ গ্যাং সদস্যরা মাদকের টাকা জোগাড় করতেও ডাকাতি-দস্যুতার দিকে ঝুঁঁকছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। বর্তমানে দেশে তিন হাজার ৯৯১ কিলোমিটার হাইওয়ে রয়েছে। দুই হাজার ৮০০ জন পুলিশ এসব মহাসড়কের দেখভাল করছে। পুলিশের দাবি, লোকবল দরকার ছয় হাজার। লোকবলের অভাবে ডাকাতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শুধু মহাসড়কেই নয়, রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও থানা এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ডাকাতির ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সম্প্রতি রাতে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই রাতে যানবাহনে ভ্রমণ করতে ভয় পাচ্ছেন। তবে মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও কুমিল্লার মহাসড়ক চান্দাইল, সাভার, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জের সিমরাইলে বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড়েও বেশি ডাকাতি হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত নির্জন সড়কে ডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটছে জানিয়ে হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব এলাকায় অনেককে আগে থেকে টার্গেট করেও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে প্রবাসীদের গাড়ি টার্গেট করছে ডাকাতদল। তাদের বিমানবন্দর থেকেও অনুসরণ করা হতে পারে। হাইওয়েতে বর্তমানে দেড় হাজারের বেশি দুর্বৃত্ত সক্রিয়। যারা ডাকাতির সময় দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ডাকাতদের গ্রেফতার এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা তুলনামূলক অনেক কম।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র সবসময় বোঝা যায় না। যে ঘটনাগুলোর অভিযোগ পুলিশে কাছে যায় সেগুলোই মামলা বা সাধারণ ডায়েরি হিসেবে নথিবদ্ধ করে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে যান না ঝামেলার ভয়ে। গণঅভ্যুথানের ছয় মাস পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি না হওয়ায় মানুষের মনে নিরাপত্তা প্রশ্নে ভয়ের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
জানা গেছে, গত শনিবার গভীর রাতে তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড়ে গণডাকাতি হয়। এ সময় মহাসড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে ডাকাতদলের পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে শুক্রবার মধ্যরাতে পাবনার সাঁথিয়ায় গণডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর আগে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বিদেশ থেকে আসা দুজন প্রবাসী ডাকাতদলের কবলে পড়েন। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কুমিল্লার মিয়াবাজার হাইওয়ে থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে রাজশাহীগামী একটি যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতির সময় দুই নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ মিলেছে। গত ১৪ জানুয়ারি র্যাব পরিচয়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দরে যাত্রীবাহী বাসের গতিরোধ করে দুই প্রবাসীকে তুলে নিয়ে মারধর ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারে চলন্ত বাসে যাত্রীবেশে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। গত দুই মাসে বাগেরহাট, সুনামগঞ্জ, সিলেটসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় রাতে বাস থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া গত ১৫ জানুয়ারি মহাসড়কের মিশ্বানী এলাকায় ৩০০ বস্তা চালভর্তি ট্রাক পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি মহাসড়কের পাশে অবস্থিত মিয়াবাজার মসজিদ মার্কেটে প্রীতি জুয়েলার্সে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় ডাকাতদল গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। লুট হয় ৩৫ ভরি স্বর্ণ। ডাকাতদের গুলিতে আহত হন মোশাররফ নামের এক ব্যবসায়ী। গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে নওগাঁর পতœীতলায় সড়কে গাছ ফেলে একটি বাস ও একটি মাইক্রোবাসে ডাকাতি হয়। একই রাতে ঢাকার আশুলিয়ার জিরানীতে নিজ বাসায় ডাকাতের গুলিতে আহত হন অভিনেতা আজিজুর রহমান আজাদ। ডাকাতিতে বাধা দেয়ায় তার পায়ে তিনটি গুলি করা হয়। তার মা ও স্ত্রীও আহত হন। গত রোববার ঢাকার সাভারে রাজধানী পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসময় বাসে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নেন ডাকাত দল।
পুলিশের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে ডাকাতি ও দস্যুতার (ছিনতাই) ঘটনায় মামলা বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪২টি, যা গত বছর ২০২৪ সালের একই মাসের তুলনায় ৯৯টি বা ৬৯ শতাংশ বেশি। ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় গত ডিসেম্বরে মামলা হয়েছে ২৩০টি, যা গত ২০২৩ সালের একই মাসের তুলনায় ৯৫টি বা ৭০ শতাংশ বেশি। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে এক হাজার ১৪৫টি, যা ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের তুলনায় ৩৮২টি বা ৫০ শতাংশ বেশি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের দোসররা। তাদের হাতে প্রচুর টাকা রয়েছে। সেসব টাকা দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে। কিন্তু সেই সুযোগ তারা পাবে না। তাদের সবার ঘুম হারাম করে দেবো। দ্রুত আইনশঙ্খলা উন্নয়ন হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি দেলোয়ার হোসেন মিঞা সাংবাদিকদের বলেন, স্বীকার করছি, সম্প্রতি মহাসড়কে ডাকাতি বেড়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নিয়েছি। ঈদকে সামনে রেখে বর্তমানে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা বাড়ছে বলে তথ্য পেয়েছি। ডাকাতিসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশ পুলিশ বাহিনীতে রয়েছে। তাদের গা-ছাড়া ভাব রয়েছে। এছাড়া ওই সময়ে পুলিশে সুবিধাভোগীদের একটি অংশও রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অনেক অপরাধী জামিনে মুক্তি পেয়েছে। পুলিশের যথাযথ টহল, নজরদারি, সক্রিয়তা না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।
পুলিশের বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, মাদকে দেশ এখন বলতে গেলে সয়লাব। মাদকাসক্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিভিন্ন বয়সী মানুষ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, এমন কি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও বাদ নেই। দেশে মোট মাদকসেবীর সংখ্যা এখন এক কোটির ওপর। মাদকসেবীরা শুধু সেবনেই যুক্ত নেই, মাদক ব্যবসা, মাদক বহন ইত্যাদির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। মাদকাসক্তি এমন এক আসক্তি, যার কারণে অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে মাদকাসক্তরা। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, খুনÑ কোনো কিছুতেই তারা পিছপা হয় না। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বলে এসব কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন।