Bangladesh

ডিগবাজি দিয়ে অন্য দলের প্রার্থী নয়

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের নীতিগত সিদ্ধান্ত

জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে এক দল থেকে আরেক দলে ডিগবাজির পথ বন্ধের সুপারিশের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’। সেখানে দলীয় প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন পেতে হলে ওই দলের অন্তত তিন বছর সদস্যপদ থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার জন্য তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সুপারিশও থাকতে হবে। এজন্য সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৬ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) এর ১২ ধারা সংশোধনীর সুপারিশ করার পরিকল্পনা রয়েছে এ কমিশনের। এ বিধান যুক্ত হলে নির্বাচনে এক দলের মনোনয়ন না পেয়ে আরেক দলে যোগ দিয়েই প্রার্থী হওয়ার সুযোগ বন্ধ হবে। এতে মনোনয়ন কেনাবেচায় টাকার খেলাও কমবে। কমিশনের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা গেছে, নির্বাচন এলেই দল ভাঙাগড়ার খেলা শুরু হয়। এজন্য চলে টাকার খেলাও। এই খেলায় যুক্ত হন রাজনীতিক, সরকারি আমলা ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ ছিল। ওই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগ মুহূর্তে বিএনপি থেকে হঠাৎ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ঝালকাঠী-১ আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন শাহজাহান ওমর বীর উত্তম। ওই নির্বাচনে তিনি জয়ীও হন। বর্তমানে তিনি কারাগারে আটক রয়েছেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এ ধরনের খেলা বন্ধের বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন।

সূত্র জানায়, নির্বাচন ব্যবস্থায় অন্তত ১৫-১৬টি বিষয়ের ওপর সংস্কার প্রস্তাব করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে কমিশন। বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে ওইসব বিষয়ের ওপর মতামতও নিচ্ছে। এসব বিষয়ের অন্যতম হচ্ছে-নির্বাচনে অটোপাশ বন্ধ করা। বর্তমানে কত শতাংশ ভোট পড়লে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে-তার কোনো মান নির্ধারণ করা নেই। ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারির সময়ে অনুষ্ঠিত ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে মাত্র সোয়া ৫ শতাংশ ভোট পড়ে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মাত্র ১৫ হাজার ৯৫৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ভোটারের অংশবিহীন এমন নির্বাচন বন্ধে সুপারিশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য ভোট পড়ার ন্যূনতম একটি হার নির্ধারণ করে এর কম ভোট পড়লে তা বাতিলের সুপারিশ করবে। ওই হার ৫০ শতাংশ হবে নাকি আরও কম হবে-তা চূড়ান্ত হয়নি।

অন্যান্য বিবেচনাধীন সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত করা, ‘না’ ভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা, নির্বাচন এবং প্রার্থিতা বাতিলে ইসির ক্ষমতা বাড়ানো, পোস্টাল ব্যালট কার্যকর করা এবং সংসদীয় নারী আসনের সংখ্যা বাড়ানো ও নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা। আরও রয়েছে-রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা, প্রার্থী, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের নির্বাচনি অপরাধের সাজা সুনির্দিষ্ট করা, নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্ন অডিট করা, হলফনামার তথ্য যাচাই করা, নির্বাচনি অভিযোগ দাখিল ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া, নির্বাচনি মামলা নিষ্পত্তিতে সময় বেঁধে দেওয়া ও ইসির ভূমিকা, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত বিধিবিধান সংস্কার করা।

জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, আমরা অনেক বিষয়ে সংস্কারের জন্য সুপারিশ করার লক্ষ্যে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছি। তবে কোনো বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেইনি। অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার পর বিষয়গুলো চূড়ান্ত করব। তবে যেসব বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছি তার মধ্যে প্রার্থী হতে দলের ৩ বছর সদস্যপদ থাকা, না ভোট যুক্ত করা, সংসদের উচ্চকক্ষের প্রবর্তন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়ার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে আমাদের সংলাপে যেসব মতামত আসছে, সেগুলোর ভিত্তিতে সুপারিশ চূড়ান্ত করা হবে। আমাদের নিজস্ব কোনো এজেন্ডা নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর রাষ্ট্র সংস্কারে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই একটি ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। জানা গেছে, এই কমিশন গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৩০টি বৈঠক করেছে। এর মধ্যে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, নারী প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকও রয়েছে। বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন ও চার কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। নির্বাচন ও আইন বিশেষজ্ঞ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে কমিশনের। চলতি মাসেই সুপারিশ জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওয়ান-ইলেভেনের পর নির্বাচন ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে। ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন নির্বাচনি আইন ও বিধিমালায় ব্যাপক সংশোধনী এনেছিল। ওই আইনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সংস্কারের অনেক কিছুই বাদ দিয়ে আরপিও পাশ করে। সর্বশেষ কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন অনিয়ম বা ক্ষমতা প্রভাব বিস্তারের কারণে যেকোনো সময়ে নির্বাচন বাতিলে ইসির যে ক্ষমতা আরপিওর ৯১এ ধারায় ছিল তা বাতিলের সুপারিশ করেছিল। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বাদ পড়া ওইসব বিধান আবারও ফিরিয়ে আনতে চায়। আরও জানা গেছে, সংবিধানের ১১৮-১২৬ ধারা নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। সেখানেও কিছু সংস্কারের সুপারিশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনকালে সহায়তা করার সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য অংশে সংশোধনীর প্রস্তাব করা হবে। সেখানে নির্বাহী বিভাগ কি কি সহায়তা করবে তা সুনির্দিষ্ট করার প্রস্তাব করার বিষয়ে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া একজন পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে যাতে থাকতে না পারেন-সেই বিষয়ে সুপারিশ আসতে পারে।

জাতীয় সংসদের আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইনে সংশোধনীর সুপারিশ করবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। ওই আইনে সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের যুক্তের প্রস্তাব করা হতে পারে। প্রবাসীদের ভোটার করা এবং তাদের ভোট প্রয়োগের সুযোগ দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে এই কমিশন। এক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যালটের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী, ভোটগ্রহণে নিয়োজিত ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিকসহ জরুরি পেশার মানুষদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করবে নির্বাচন সংস্কার কমিশন।

কমিশনের একাধিক সদস্য জানান, নির্বাচনে ‘না’ ভোটের বিধান চালু হলে নির্বাচনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোটার অংশগ্রহণ বাড়বে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে এ বিধান চালুর ক্ষেত্রে সদস্যরা নীতিগত একমত হয়েছেন। ‘না’ ভোট চালু হলে একক প্রার্থী হিসাবে জয়ী হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ ওই প্রার্থীর চেয়ে ‘না’ ভোট বেশি পড়লে সেখানে আবারও নির্বাচন হবে। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের প্রার্থী দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে। আওয়ামী লীগ যেভাবে ইচ্ছামতো বিভিন্ন ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রার্থী করে জয়ী করে এনেছে, সেই সুযোগ বন্ধ হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d