ডিজিটালাইজেশনে হিমশিম, বাংলাদেশের অবস্থান ১২১ দেশের মধ্যে ৮২
ইলেকট্রনিক নিরাপত্তায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে উগান্ডা নাইজেরিয়া
দেশ ডিজিটালাইজেশনের পথে যাত্রা করে প্রায় দেড় যুগ আগে। কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে সব সরকারি সেবা যে কোনো স্থান থেকে সহজে, স্বচ্ছভাবে, কম খরচে ও কম সময়ে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের ডিজিটাল যাত্রায় সুফলও এসেছে। হাতে হাতে এখন মোবাইল। ঘরে বসে অনলাইনে করা যাচ্ছে কেনাকাটা। লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইনে। ৯৯৯-এ ফোন করলেই মিলছে নানা সহায়তা। তবে ২০২৪ সালে এসেও এখনো অধিকাংশ সরকারি সেবা পেতে হাজির হতে হচ্ছে সশরীরে। এনআইডি থাকা সত্ত্বেও ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আঙুলের ছাপ দিতে যেতে হচ্ছে বিআরটিএ অফিসে। ধীরগতির ইন্টারনেট লাগাম টানছে ডিজিটাল উন্নয়নের। আধুনিক টোল প্লাজায় টোল দিতে হচ্ছে হাতে হাতে। এনআইডি সার্ভার থেকে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য। ব্যাংক থেকে গায়েব হয়ে যাচ্ছে গ্রাহকের টাকা।
এদিকে সরকারি সেবা ডিজিটাল করতে গত এক দশকে শুধু অবকাঠামো তৈরিতেই বিনিয়োগ হয়েছে কয়েক লাখ কোটি টাকা। তবুও ডিজিটালাইজেশনে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশ। সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক প্রকাশিত ‘ডিজিটাল কোয়ালিটি অব লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ বা ডিজিটাল জীবনমান (ডিকিউএল) সূচকে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ছয় ধাপ অবনমন হয়েছে বাংলাদেশের। ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮২তম। ২০২২ সালে ছিল ৭৬তম। এশিয়ার ৩৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। ইন্টারনেট ব্যবহারের সামর্থ্য, ইন্টারনেটের মান, ই-অবকাঠামো, ই-নিরাপত্তা, ই-গভর্নমেন্ট এ পাঁচটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ডিকিউএল ইনডেক্স নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠানটি। এতে দেখা যায়, ইন্টারনেট ব্যবহারের সামর্থ্যে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৪৮ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ইলেকট্র্রনিক নিরাপত্তায় পিছিয়েছে ১০ ধাপ।
তবে এক ধাপ উন্নতি হয়েছে ইলেকট্র্রনিক অবকাঠামোয়। ১৩ ধাপ উন্নতি হয়েছে ই-গভর্নমেন্টে, দুই ধাপ উন্নতি হয়েছে ইন্টারনেটের মানে। তবে উন্নতির পরও ইন্টারনেটের গতিতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের পেছনে বাংলাদেশের অবস্থান। ডিজিটাল জীবনমান (ডিকিউএল) সূচকে ১ নম্বরে রয়েছে ফ্রান্স, ২ নম্বরে ফিনল্যান্ড, ৩ নম্বরে ডেনমার্ক, ৪ নম্বরে জার্মানি, ৫ নম্বরে লুক্সেমার্গ, ৬ নম্বরে স্পেন, ৭ নম্বরে এস্তোনিয়া, ৮ নম্বরে অস্ট্রিয়া, ৯ নম্বরে সুইজারল্যান্ড এবং ১০ নম্বরে সিঙ্গাপুর। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ২০তম, জাপান ১৬তম, সাইপ্রাস ৩১তম, মালয়েশিয়া ৩৭তম, সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩৮তম, চীন ৪৪তম, সৌদি আরব ৪৫তম, কাজাখস্তান ৪৭তম, কাতার ৪৮তম, থাইল্যান্ড ৫১তম, ভারত ৫২তম, ভিয়েতনাম ৫৬তম, ফিলিপাইন ৬০তম, কিরগিজস্তান ৭১তম, বাংলাদেশ ৮২তম, শ্রীলঙ্কা ৮৬তম, পাকিস্তান ৯৩তম, নেপাল ৯৪তম অবস্থানে রয়েছে।
ডিকিউএল সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অবশ্য ভারতের পরপরই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। তবে ইন্টারনেট ক্রয়ক্ষমতা, ইন্টারনেটের মান, ইলেকট্র্রনিক অবকাঠামো, ইলেকট্র্রনিক নিরাপত্তা ও ইলেকট্র্রনিক গভর্নমেন্ট সূচকগুলোর মধ্যে শুধু ইলেকট্র্রনিক অবকাঠামোতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো থেকে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। অবশ্য সব সূচকে বিশ্বের গড় মানের চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে পিছিয়ে ইলেকট্র্রনিক নিরাপত্তায়। দক্ষিণ এশিয়ায় ইলেকট্র্রনিক অবকাঠামোয় প্রথম বাংলাদেশ, ইন্টারনেট ক্রয়ক্ষমতায় প্রথম শ্রীলঙ্কা, ইন্টারনেট মান, ইলেকট্র্রনিক নিরাপত্তা ও ই-গভর্নমেন্টে প্রথমে রয়েছে ভারত। এদিকে পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্র দেশ নাইজেরিয়া ইন্টারনেটের মান (৬২তম) ও ইলেকট্র্রনিক নিরাপত্তায় (৭৩তম) এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এ দুটি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ৬৫তম ও ৮৫তম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশকে ডিজিটাল করতে হার্ডওয়্যার ক্রয়ের মাধ্যমে ইলেকট্র্রনিক অবকাঠামো উন্নয়নে একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করে প্রচুর ব্যয় করা হলেও অন্যান্য খাতগুলোয় মনোযোগ দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছা থাকলেও বাস্তবায়নের দায়িত্বে যারা আছেন তারা লুটপাটে ব্যস্ত। ফলে কাক্সিক্ষত সুফল আসছে না। এখনো ইন্টারনেটের মান খুবই খারাপ, আবার দামও বেশি। তৈরি হচ্ছে না কারিগরিভাবে দক্ষ জনবল। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় বসে কাজের সুবিধার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ল্যাপটপ সরবরাহ করা হলেও তাদের টেবিল থেকে ফাইলের স্তূপ সরছে না। সরকারি অফিসে অধিকাংশ কাজই এখনো ম্যানুয়ালি চলে। পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন, জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি সংশোধনসহ নানা কাজে হাজির হতে হয় সশরীরে। কোনো হাসপাতালের শয্যার তথ্য অনলাইনে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে জালিয়াত চক্র মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অনলাইনে প্রতারণা বাড়ছে।
ডিজিটাল ডেটাবেজের সুষ্ঠু ব্যবহার না করায় করের আওতায় আসেনি অধিকাংশ মানুষ। ডিজিটাল মাধ্যমে নিরাপত্তার বিষয় সবচেয়ে অবহেলিত। গত বছরের জুলাই মাসে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ওয়েবসাইট থেকে তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এরপর টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন সোশ্যাল অ্যাপে এনআইডির তথ্য ফাঁস হয়। এগুলো ডিজিটালাইজেশনের চরম দুর্বল দিক। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর সরকারের সব অফিস ও দফতর ‘ডিজিটাল’ করার উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কেনাকাটা ও প্রকল্প গ্রহণের হিড়িক পড়ে। তবে এখন পর্যন্ত একটি মন্ত্রণালয় বা দফতর পুরোপুরি ডিজিটাল হতে পারেনি। অন্যদিকে ২০১৪ সালে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং দেশটিকে ‘বিশ্বের প্রথম স্মার্ট নেশন’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ২০২১ সালেই স্মার্ট শহরের সূচকে (IMD-SUTD Smart City Index) সিঙ্গাপুরের অবস্থান ছিল বিশ্বে সবার ওপরে। ডিজিটাল ব্যবস্থায় ৯৯ শতাংশ সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে দেশটি।