Bangladesh

‘মাছ-মাংসের আশা করি না, শেষ ভরসা সবজিতেও আগুন’, নিম্নমধ্যবিত্তের আমিষে টান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নৈতিকতার অবক্ষয়

দীর্ঘদিন ধরেই নিত্যপণ্য, কাঁচাবাজার, মাছ-মাংস, এমনকি মসলাজাত পণ্যের দামে হাঁসফাঁস অবস্থা সাধারণ মানুষের। বাজার অস্বস্তিতে ভোগান্তির অন্ত নেই। বিভিন্ন সময় নানা পণ্যের দাম কিছুটা ওঠানামা করলেও বাজার ছুটছে ঊর্ধ্বমুখী। সম্প্রতি আগাম কিছু শীতকালীন সবজি বাজারে আসতে শুরু করলেও দাম যেন আকাশছোঁয়া।

শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ন্যূনতম ৬০-৭০ টাকার কমে তেমন কোনো সবজি মিলছে না। শুধু পেঁপে আর মিষ্টি কুমড়ার কেজি তুলনামূলক একটু কম। এছাড়া বেশিরভাগ সবজির দামই চড়া।

রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা পর্যায়ের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতকালীন সবজির মধ্যে প্রতি কেজি শিম ২০০ টাকা, মূলা ৬০-৭০ টাকা ও টমেটো ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম ৬০ টাকা, স্থানভেদে বেশিও বিক্রি হচ্ছে। লাউয়ের দামও চড়া।

এছাড়া আলু ৫০-৬০ টাকা কেজি, করলা ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা, বেগুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা, মূলা ৭০ টাকা, পটল ৮০-৯০ টাকা, পেঁপে ২৫-৩০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে কাঁচামরিচ ২০০ টাকা কেজি, ঝিঙা ৮০, উস্তা ১০০ ও কচুর লতি ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। গাজর প্রতি কেজি ১২০ টাকা, প্রতি পিস জালি ৫০-৬০ টাকা ও লাউ প্রতি পিস ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

অপরদিকে কাঁচা কলা প্রতি হালি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শসা প্রতি কেজি ৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর রায়েরবাজারে কথা হয় ক্রেতার সঙ্গে। তিনি সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম নিয়ে হতাশ। জাকারিয়া বললেন, আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। মাছ-মাংস এখন আশাও করি না। শেষ ভরসা সবজি, সেটাতেও আগুন। ডিম-ডাল-আলু দিয়ে ভাত খেতেও এখন কষ্ট হয়ে যায়।

ক্রেতা শরীফ রুবেল বলেন, আগে বাজারে গেলে ৫০০ টাকায় ব্যাগভর্তি সবজি কেনা যেত। এখন ব্যাগের তলাও ভরে না। যা কিনতে যাই- বিরক্ত লাগে, অস্বস্তি লাগে। একেবারে কম হলেও ৫০-৬০ টাকার নিচে কিছু নেই। বাজারে এলে অনেকটা হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়।

এদিকে সবজি বিক্রেতারা বলছেন, শীতের সবজি বাজারে এলেও চাহিদার অনুপাতে তা খুব কম। ক্রেতাদের চাহিদামতো কিনতে পারছি না। বাধ্য হয়ে একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। সার ও কীটনাশকের দাম অনেক বেশি, শ্রমিক মজুরিও অনেক। কৃষক পর্যায় থেকেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

অপরদিকে সম্প্রতি ডিমের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়। ডজনে দাম হয়ে গিয়েছিল ১৮৫ টাকা, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। তবে বর্তমানে ফার্মের মুরগির ডিম ডজনে ১৫৫ এবং হালিতে বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া হাসের ডিমের হালি ৬৫-৭০ টাকা।

মাছের বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, স্থানভেদে পাঙ্গাস বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৬০ টাকা কেজি দরে। অল্প কম-বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চাষের কই ও তেলাপিয়া। এক কেজির রুই-কাতলার দাম হাঁকানো হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা কেজি। দুই থেকে আড়াই কেজির রুই-কাতলার দাম কেজিতে ৩৭৫ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া স্থানভেদে শোল মাছ প্রতি কেজি ৬০০-৬৫০ টাকা এবং শিং মাছ ও বাইলা মাছ প্রতি কেজি প্রকারভেদে ৬০০-৬৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে মাংসের বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগির দাম ১৯০ থেকে ২০০ টাকা কেজি। এছাড়া সোনালি জাতের মুরগির কেজি ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা। পাকিস্তানি মুরগি ৩৪০-৩৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগি কিনতে কেজিতে খরচ হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। কিছু স্থানে ৭০০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গরুর মাংস ৮০০ টাকা, খাসির মাংস ১১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। স্থানভেদে কম-বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অযৌক্তিক ঊর্ধ্বমূল্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কষ্টের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অযৌক্তিকভাবে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে পণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য হতে পারে। যেমন—পণ্যের উত্পাদন ব্যয় বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, যুদ্ধবিগ্রহ, উত্পাদনের স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হতে পারে। কিন্তু অনেক সময় কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই যখন দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয় এবং তা সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হয়, তখন বিষয়টির অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন বলে বোধ করি।

আসলে এর মূল কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অনৈতিকতা এবং অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক মুনাফালাভের আকাঙ্ক্ষা। কিছু কিছু ব্যবসায়ীর নৈতিকতার অবক্ষয় ও সামাজিক দায়বদ্ধহীনতা তাদের মুনাফা বৃদ্ধির এই আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী পরিকল্পিতভাবে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। অথচ ইসলামে এইরূপ মজুতদারি নিষিদ্ধ। জীবিকা নির্বাহের সর্বোত্তম পেশা হিসেবে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে অবশ্যই উত্সাহিত করেছে। আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মদ (স.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনগণ ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন’ (সুরা বাকারা-২৭৫)। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, মহান আল্লাহ মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য উত্সাহিত করেছেন। তবে তা আল্লাহর নির্দেশিত হালাল পন্থায় পরিচালিত হতে হবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসার শর্ত হলো ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টি। নবি করিম (স.) বলেন, আমানতদার ব্যবসায়ীরা হাশরে নবিদের, সত্যবাদীদের ও শহিদদের সঙ্গে থাকবেন (তিরমিজি ১০২৯)। এই হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, ব্যবসা শুধু জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যমই নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশিত পথে আমানতদারির সঙ্গে ও ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টির মাধ্যমে নৈতিকভাবে পরিচালিত হলে সে ব্যবসা ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে। কিন্তু মানুষকে কষ্ট দিয়ে, নৈতিকতাবিবর্জিত পন্থায় শুধু নিজের সাময়িক আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে ব্যবসা পরিচালনা ইবাদত হতে পারে না। অতিমুনাফা বা অনৈতিক গুদামজাত ও সিন্ডিকেট করে উচ্চমূল্যে কোনো দ্রব্য কিনতে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। মহান আল্লাহ ও তার প্রিয় রসুল (স.) এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে আমাদের সাবধান করেছেন।

আল্লাহ allah

নবি করিম (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গুদামজাত করল, সে বড় অপরাধ করল’ (মুসলিম শরিফ ১৬০৫)। উল্লেখ্য, দোয়া কবুলের পূর্বশর্ত হালাল রোজগার। রসুল (স.) বলেন, ‘অবশ্যই ব্যবসায়ীদের কেয়ামতের দিন অপরাধী হিসেবে উপস্থিত করা হবে। তবে যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, সত্কর্ম করে এবং সত্য কথা বলে, তাকে ছাড়া’ (তিরমিজি-১২১৯)। আমরা অনেকেই দৃশ্যত আল্লাহকে ভয় করি, মহানবি (স.)কে ভালোবাসি এবং মহান আল্লাহর পথে ও নবির আদর্শে জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করি। নিয়মিত নামাজ, রোজা, জাকাত আদায় ও হজ পালন করি। কিন্তু নৈতিকতার অনুসরণে এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথে ব্যবসা পরিচালনা করি না। বিশেষত খাদ্যদ্রব্য মজুত করে তা বেশি মুনাফায় বিক্রি করে ব্যক্তিজীবনে লাভবান হওয়ার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হই। ব্যবসায় লাভ একটি যৌক্তিক বিষয়, কিন্তু যখন যৌক্তিকতা ও নৈতিকতাকে ছাড়িয়ে যায়, তাকে বলা হয় জুলুম। মহান আল্লাহ জুলুমকারীদের জন্য রেখেছেন কঠোর শাস্তির বিধান।

মহান আল্লাহ তার সৃষ্টির প্রতি সদয় হতে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তার সৃষ্টির হক আদায় আমাদের নিশ্চিত করতে বলেছেন। নৈতিক পন্থায় ও আল্লাহর প্রদর্শিত পথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে পরকালে যেভাবে কল্যাণের পথে আমরা ধাবিত হতে পারি, ঠিক তেমনি অনৈতিক পন্থায় ব্যবসা পরিচালনা এবং খাদ্যদ্রব্য মজুতদারি, অযৌক্তিক মুনাফা ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমরা যেন পরকালে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি না হই, সে বিষয়ে সবার সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

Show More

5 Comments

  1. I used to be suggested this web site by my cousin. I am not
    sure whether this post is written by means of him
    as nobody else realize such targeted approximately my difficulty.

    You are wonderful! Thank you!

  2. I must thank you for the efforts you have
    put in penning this site. I really hope to view the same high-grade content
    from you in the future as well. In fact, your creative writing abilities has inspired me
    to get my very own site now 😉 SpeedyIndex

  3. Thanks for finally writing about > ‘মাছ-মাংসের
    আশা করি না, শেষ ভরসা সবজিতেও আগুন’, নিম্নমধ্যবিত্তের আমিষে টান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
    ও নৈতিকতার অবক্ষয় – MI Probashi SpeedyIndex

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto