ডিসিদের মতো এসপিদেরও ফিটলিস্ট
বিতর্ক ও সমালোচনা এড়াতে জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) নিয়োগে ফিটলিস্টের দিকে যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেই আলোকে এসপিদের নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ একটি নীতিমালা তৈরি করবে। চলতি বছরের মধ্যেই নীতিমালার কাজ শেষ হলে এসপিদের নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
সম্প্রতি এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওইসব বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছেন।
জানা গেছে, ওই নীতিমালায় উল্লেখ থাকবে কীভাবে এসপিদের নিয়োগ দেওয়া হবে। নিয়োগের আগে প্রার্থীদের নেওয়া হবে মৌখিক পরীক্ষা।
অভিযোগ আছে, তদবির করে অনেকেই পছন্দের জেলায় এসপি হয়ে যাচ্ছেন। নীতিমালা না থাকায় তদবির করার সুযোগ পাচ্ছেন। এতে করে যারা যোগ্য তারা বাদ পড়ছেন। তদবিরের কারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিরক্ত হচ্ছেন বলে আলোচনা আছে।
এদিকে, পুলিশ বাহিনীতে আরও নতুন পদ সৃষ্টি করার দাবি জানিয়েছে পুলিশ। এ নিয়ে সরকারের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করছেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি পুলিশে সুপারনিউমারারি হিসেবে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি), অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) ও এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হলেও অতিরিক্ত ডিআইজি থেকে ডিআইজি পদে পদোন্নতি হয়নি। এই পদে ৭২ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার কথা ছিল। পদোন্নতি না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ডিআইজি পদে শিগগিরই পদোন্নতি দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, দীর্ঘদিন ধরেই জেলার এসপিদের নিয়োগ নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক আছে। এই বিতর্ক এড়াতে এখন সরকার বিকল্প পথে যাচ্ছে। ডিসিদের যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, ঠিক সেভাবেই এসপিদের নিয়োগ দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করছে সরকারের হাইকমান্ড। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফিটলিস্টের মাধ্যমেই এসপি নিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, ফিটলিস্টের মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে উপসচিবদের ডিসি পদে নিয়োগ দিয়ে আসছে সরকার। জেলার এসপিদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে একই নিয়ম অনুসরণ করা যায় কি না, তা নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যেই এসপিদের নিয়োগ নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করা হবে। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ কাজ করছে। তা ছাড়া নীতিমালা ঠিক করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হবে। কমিটিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি দপ্তরের কর্মকর্তাদের রাখার কথা রয়েছে। নীতিমালা ঠিক হওয়ার পর ফিটলিস্টের মাধ্যমে যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবীদের মধ্য থেকে বিভিন্ন জেলায় এসপি নিয়োগ দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যদের বাছাই করতে যেমনভাবে ফিটলিস্ট করা হয়, একইভাবে জেলার এসপি নিয়োগের ক্ষেত্রেও ফিটলিস্ট হবে। এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, নীতিমালা না থাকায় তদবিরের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অতীতে তদবিরে নিয়োগের বিষয়টি আলোচিত। এতে অসুবিধা হলো, যোগ্য ও দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা এসপি পদে নিয়োগ বঞ্চিত হচ্ছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, ফিটলিস্টের মাধ্যমে এসপি নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে সরকারের হাইকমান্ড থেকে ইতিবাচক সিগন্যাল পাওয়া গেছে। সিগন্যাল পাওয়ার পরই মন্ত্রণালয় প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়ার আগে কর্মকর্তাদের আমলনামা তৈরি করবে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য-উপাত্তকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রশাসনের ফিটলিস্টে থাকা কর্মকর্তাদের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে থাকে। এরপর যোগ্য কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জেলায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এসপি নিয়োগের ক্ষেত্রেও এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে পদায়নের নীতিগত সিদ্ধান্তের পর জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও পুলিশের মহাপরিদর্শক মৌখিক পরীক্ষা নেবেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার এক বছর পর ডিসি পদে পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট করা হয়। এ ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন ও পুরো চাকরিজীবনের শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়। একই প্রক্রিয়ায় পুলিশ সুপার নিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ডিসিদের পদে নিয়োগ পাওয়ার আগে প্রথমে এসিল্যান্ড, তারপর পর্যায়ক্রমে সিনিয়র সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) হতে হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) মাধ্যমে উপসচিব হলে সরকার ওই কর্মকর্তাকে ডিসি নিয়োগের জন্য ফিটলিস্ট করে। ডিসি পদে নিয়োগ পেতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উপজেলা ইউএনও ও এডিসি হিসেবে মাঠ প্রশাসনে অন্তত তিন বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জেলার এসপিদের ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা রাখতে চায়। মাঠপর্যায়ে জেলার এসপিদের দক্ষতা থাকতেই হবে। বর্তমানে কিছু জেলার এসপি আছেন তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেননি। ফিটলিস্ট হলে দক্ষতা না থাকলে এসপি হওয়ার সুবিধা পাবেন না কেউ। এসপি নিয়োগের নীতিমালাটিও মূলত ডিসি নিয়োগের নীতিমালার মতোই হবে বলে জানান জননিরাপত্তা বিভাগের ওই কর্মকর্তা।
পুলিশে পদ বাড়ানোর দাবি : প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পদ বাড়ানো হলেও পুলিশে সেই হারে নতুন পদ সৃষ্টি হচ্ছে না বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান। তারা বলছেন, এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে। কয়েক মাস আগে সুপারনিউমারারি হিসেবে বেশ কয়েকটি পদ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া পদ খালি সুপারনিউমারারিতে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের সেখানে পদায়ন করা হবে বলে মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দপ্তরকে বলা হয়েছে। ১২ জন অতিরিক্ত আইজিপি, ১৪০ জন অতিরিক্ত ডিআইজি ও ১৫০ জন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। তবে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আরও পদ বাড়ানোর একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতির জন্য ৫২৯টি পদ সৃষ্টি করতে আবেদন করেছিল পুলিশ সদর দপ্তর। এর মধ্যে অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫টি, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪টি, ডিআইজি ১৪০টি, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০টি ও পুলিশ সুপার ১৯০টি পদ চেয়েছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসনে আবেদনের পর গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ৩৪২টি পদ দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত আইজিপি পদে ২, ডিআইজি পদে ৫০, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে বলা হয়। এ নিয়ে পুলিশে ক্ষোভ দেখা দিলে অতিরিক্ত আইজিপির পদ আরও ১০টি ও ২২টি ডিআইজি পদ বাড়ানো হয়।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সুপারনিউমারারি দিলেও পুলিশের পদ কিন্তু বাড়েনি। অথচ মাসখানেক আগে প্রশাসন ক্যাডারে নতুন পদ সৃষ্টি করেছে। সামনে আরও তৈরি হবে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। কিন্তু আমাদের জন্য নতুন পদ তৈরি হচ্ছে না। ৭২ জন অতিরিক্ত ডিআইজি থেকে ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টিও ঝুলে আছে। নির্বাচনের আগেই তাদের পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিল। এ জট কবে খুলবে কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না।’
তবে পুলিশে আরও নতুন পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আলোচনা করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্যাডারদের পাশাপাশি নন ক্যাডাররাও পদোন্নতি পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে আমরা হতাশ। আমাদের আশা প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখবেন।’
পুলিশের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীর কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে বাহিনীতে উচ্চপর্যায়ে চার শতাধিক নতুন পদ সৃষ্টির দাবি তোলা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। আমরা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, যেমন ঔষধ প্রশাসন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএসহ বিভিন্ন সংস্থায় পুলিশ সদস্যদের প্রেষণে নিয়োগ দেওয়ার কথাও বলেছি। একই সঙ্গে নারী পুলিশের সংখ্যা দ্বিগুণ করা, তাদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি এবং সুদমুক্ত গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা, আবাসনসুবিধা এবং বিভিন্ন দূতাবাসে পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের দাবিটিও সামনে আনা হয়। কিন্তু কোনো কিছুই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। আশা করি সরকার বিষয়টি আমলে নেবে।’